Thursday, April 14, 2016

= >> ছোটদের ছড়া-কবিতা



 

লিচু চোর

 ছোটদের ছড়া-কবিতা, নজরুল ইসলাম

বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাড়া
পুকুরের কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গো যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,
বাবা মড়াত করে
পড়েছি সরাত জোরে।
পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,
সে ছিল গাছের আড়েই।
ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার,
ধুমাধুম গোটা দুচ্চার
দিলে খুব কিল ঘুষি
একদম জোরসে ঠুসি
আমিও বাগিয়ে থাপড়
দে হাওয়া চাপিয়ে কাপড়
লাফিয়ে ডিঙনু দেয়াল,
দেখি এক ভিটরে শেয়াল
সেকি ভাই যায় রে ভুলা-
মালীর পিটুনিগুলা!
কি বলিস ফের হপ্তা!
তৌবা-নাক খপ্তা!


==========================================================

চড়িভাতি

ছোটদের ছড়া-কবিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ফল ধরেছে বটের ডালে ডালে
অফুরন্ত আতিথ্যে তার সকালে বৈকালে 
বনভোজনে পাখিরা সব আসছে ঝাঁকে ঝাঁক
মাঠের ধারে আমার ছিল চড়িভাতির ডাক  
যে যার আপন ভাঁড়ার থেকে যা পেল যেইখানে 
মালমসলা নানারকম জুটিয়ে সবাই আনে  
জাত-বেজাতের চালে ডালে মিশোল 'রে শেষে 
ডুমুরগাছের তলাটাতে মিলল সবাই এসে  
বারে বারে ঘটি 'রে জল তুলে কেউ আনে
কেউ চলেছে কাঠের খোঁজে আমবাগানের পানে  
হাঁসের ডিমের সন্ধানে কেউ গেল গাঁয়ের মাঝে
তিন কন্যা লেগে গেল রান্নাকরার কাজে  
গাঁঠ-পাকানো শিকড়েতে মাথাটা তার থুয়ে 
কেউ পড়ে যায় গল্পের বই জামের তলায় শুয়ে  
               সকল-কর্ম-ভোলা 
দিনটা যেন ছুটির নৌকা বাঁধন-রশি-খোলা 
চলে যাচ্ছে আপনি ভেসে সে কোন্আঘাটায় 
               যথেচ্ছ ভাঁটায়  
মানুষ যখন পাকা 'রে প্রাচীর তোলে নাই 
মাঠে বনে শৈলগুহায় যখন তাহার ঠাঁই
সেইদিনকার আল্গা-বিধির বাইরে-ঘোরা প্রাণ 
মাঝে মাঝে রক্তে আজও লাগায় মন্ত্রগান  
সেইদিনকার যথেচ্ছ-রস আস্বাদনের খোঁজে 
মিলেছিলেম অবেলাতে অনিয়মের ভোজে  
কারো কোনো স্বত্বদাবীর নেই যেখানে চিহ্ন
যেখানে এই ধরাতলের সহজ দাক্ষিণ্য
হালকা সাদা মেঘের নিচে পুরানো সেই ঘাসে
একটা দিনের পরিচিত আমবাগানের পাশে
মাঠের ধারে , অনভ্যাসের সেবার কাজে খেটে 
কেমন 'রে কয়টা প্রহর কোথায় গেল কেটে

==========================================================


কাজলা দিদি


ছোটদের ছড়া-কবিতা, দেশের কবিতা, বিরহের কবিতা, রূপক কবিতা, যতীন্দ্র মোহন বাগচী

বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?
পুকুর ধারে লেবুর তলে থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই-
মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?
সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো;-
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো?
খাবার খেতে আসি যখন, দিদি বলে ডাকি তখন,
ওঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো?
আমি ডাকি তুমি কেন চুপটি করে থাকো?
বল মা দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে?
কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল-বিয়ে হবে!
দিদির মত ফাঁকি দিয়ে, আমিও যদি লুকাই গিয়ে
তুমি তখন একলা ঘরে কেমন করে রবে,
আমিও নাই-দিদিও নাই- কেমন মজা হবে
ভুঁই চাপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল,
মাড়াস্ নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল
ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে,
উড়িয়ে তুমি দিও না মা, ছিঁড়তে গিয়ে ফল,-
দিদি এসে শুনবে যখন, বলবি কি মা বল!
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই-
এমন সময় মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
লেবুর ধারে পুকুর পাড়ে ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোপে ঝাড়ে
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, তাইতে জেগে রই
রাত্রি হলো মাগো আমার কাজলা দিদি কই?

==========================================================

হিং টিং ছট্

  ছোটদের ছড়া-কবিতা, বিবিধ কবিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

স্বপ্ন দেখেছেন রাত্রে হবুচন্দ্র ভূপ
অর্থ তার ভাবি ভাবি গবুচন্দ্র চুপ
শিয়রে বসিয়ে যেন তিনটে বাদঁরে
উকুন বাছিতেছিল পরম আদরে
একটু নড়িতে গেলে গালে মারে চড় ,
চোখে মুখে লাগে তার নখের আঁচড়
সহসা মিলালো তারা , এল এক বেদে,
পাখি উড়ে গেছেলে মরে কেঁদে কেঁদে
সম্মুখে রাজারে দেখি তুলি নিল ঘাড়ে ,
ঝুলায়ে বসায়ে দিল উচু এক দাঁড়ে
নীচেতে দাঁড়ায়ে এক বুড়ি থুড়থুড়ি
হাসিয়া পায়ের তলে দেয় সুড়সুড়ি
রাজা বলেকী আপদকেহ নাহি ছাড়ে
পা দুটা তুলিতে চাহে , তুলিতে না পারে
পাখির মত রাজা করে ঝটপট্
বেদে কানে কানে বলে —- হিং টিং ছট্
স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান।

হবুপুর রাজ্যে আজ দিন ছয়সাত
চোখে কারো নিদ্রা নাই, পেটে নাই ভাত
শীর্ণ গালে হাত দিয়ে নত করি শির
রাজ্যসুদ্ধ বালকবৃদ্ধ ভেবেই অস্থির
ছেলেরা ভুলেছে খেলা, পন্ডিতেরা পাঠ,
মেয়েরা করেছে চুপ এতই বিভ্রাট
সারি সারি বসে গেছে, কথা নাহি মুখে,
চিন্তা যত ভারী হয় মাথা পড়ে ঝুঁকে
ভুঁইফোঁড় তত্ত্ব যেন ভূমিতলে খোঁজে,
সবে যেন বসে গেছে নিরাকার ভোজে
মাঝে মঝে দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া উৎকট
হঠাৎ ফুকারি উঠে-হিং টিং ছট্
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।

চারি দিক হতে এল পন্ডিতের দল
অযোধ্যা কনোজ কাঞ্চী মগধ কোশল
উজ্জয়িনী হতে এল বুধ-অবতংস
কালিদাস কবীন্দ্রের ভাগিনেয় বংশ
মোটা মোটা পুঁথি লয়ে উলটায় পাতা,
ঘন ঘন নাড়ে বসি টিকিসুদ্ধ মাথা
বড়ো বড়ো মস্তকের পাকা শস্যখেত
বাতাসে দুলিছে যেন শীর্ষ- সমেত
কেহ শ্রুতি, কেহ স্মৃতি, কেহ-বা পুরাণ,
কেহ ব্যাকারণ দেখে, কেহ অভিধান
কোনোখানে নাহি পায় অর্থ কোনোরূপ,
বেড়ে ওঠে অনুস্বর-বিসর্গের স্তূপ
চুপ করে বসে থাকে, বিষম সংকট,
থেকে থেকে হেঁকে ওঠে -হিং টিং ছট্
স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।

কহিলেন হতাশ্বাস হবুচন্দ্ররাজ,
ম্লেচ্ছদেশে আছে নাকি পন্ডিত সমাজ
তাহাদের ডেকে আন যে যেখানে আছে,
অর্থ যদি ধরা পড়ে তাহাদের কাছে।
কটা-চুল নীলচক্ষু কপিশকপোল
যবন পন্ডিত আসে , বাজে ঢাক ঢোল
গায়ে কলো মোটা মোটা ছাঁটাছোঁটা কুর্তি-
গ্রীষ্ম তাপে উষ্মা বাড়ে, ভারি উগ্রমূর্তি
ভূমিকা না করি কিছু ঘড়ি খুলি কয়,
সতেরো মিনিট মাত্র রয়েছে সময়—-
কথা যদি থাকে কিছু বলো চট্পট্।
সভাসুদ্ধ বলি উঠে - হিং টিং ছট্
স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান ।।
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।

স্বপ্ন শুনি ম্লেচ্ছমুখ রাঙা টকটকে,
আগুন ছুটিতে চায় মুখে আর চোখে
কিন্তু তবু স্বপ্ন ওটা করি অনুমান ,
যদিও রাজার শিরে পেয়েছিল স্থান
অর্থ চাই? রাজ কোষে আছে ভূরি ভূরি
রাজ স্বপ্নে অর্থ নাই যত মাথা খুড়ি
নাই অর্থ, কিন্তু তবু কহি অকপট
শুনিতে কী মিষ্ট আহাহিং টিং ছট্।
স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুন্যবান।

শুনিয়া সভাস্থ সবে করে ধিক্-ধিক ,
কোথাকার গন্ডমূর্খ পাষন্ড নাস্তিক!
স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন মাত্র মস্তিষ্ক বিকার
কথা কেমন করে করিব স্বীকার !
জগৎ বিখ্যাত মোরাধর্মপ্রাণজাতি
স্বপ্ন উড়াইয়ে দিবে! দুপুরে ডাকাতি!
হবুচন্দ্র রাজা কহে পাকালিয়া চোখে,
গবুচন্দ্র, এদের উচিত শিক্ষা হোক
হেঁটোয় কন্টক দাও , উপরে কন্টক,
ডালকুত্তাদের মাঝে করহ বন্টক
সতেরো মিনিটকাল না হইতে শেষ
ম্লেচ্ছ পন্ডিতের আর না মিলে উদ্দেশ
সভাস্থ সবাই ভাসে আনন্দাশ্রুনীরে,
ধর্মরাজ্যে পুনর্বার শান্তি এল ফিরে
পন্ডিতেরা মুখচক্ষু করিয়া বিকট
পুনর্বার উচ্চারিল —- হিং টিং ছট্
স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।

অতঃপর গৌড় হতে এল হেন বেলা
যবন পন্ডিতদের গুরু মারা চেলা
নগ্নশির, সজ্জা নাই, লজ্জা নাই ধড়ে—-
কাছা কোঁচা শতবার সে সে পড়ে
অস্তিত্ব আছে না আছে , ক্ষীণখর্ব দেহ,
বাক্য যবে বহিরায় না থাকে সন্দেহ
এতটুকু যন্ত্র হতে এত শব্দ হয়
দেখিয়া বিশ্বের লাগে বিষম বিস্ময়
না জানে অভিবাদন, না পুছে কুশল ,
পিতৃনাম শুধাইলে উদ্যতমুষল
সগর্বে জিজ্ঞাসা করে, কী লয়ে বিচার!
শুনিলে বলিতে পারি কথা দুই- চার,
ব্যাখ্যায় করিতে পারি উলট্পালট।
সমস্বরে কহে সবেহিং টিং ছট্
স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।

স্বপ্ন কথা শুনি মুখ গম্ভীর করিয়া
কহিল গৌড়ীয় সাধু প্রহর ধরিয়া ,
নিতান্ত সরল অর্থ, অতি পরিস্কার
বহু পুরাতন ভাব, নব আবিস্কার
ত্র্যম্বকের ত্রিয়ন ত্রিকাল ত্রিগুন
শক্তিভেদে ব্যাক্তিভেদ দ্বিগুণ বিগুণ
বিবর্তন আবর্তন সম্বর্তন আদি
জীবশক্তি শিবশক্তি করে বিসম্বাদী
আকর্ষন বিকর্ষন পুরুষ প্রকৃতি
আণব চৌম্বক বলে আকৃতি বিকৃতি
কুশাগ্রে প্রবহমান জীবাত্মবিদ্যুৎ
ধারণা পরমা শক্তি সেথায় উদ্ভুদ
ত্রয়ী শক্তি ত্রিস্বরূপে প্রপঞ্চে প্রকট,
সংক্ষেপে বলিতে গেলেহিং টিং ছট্
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।

সাধু সাধু সাধুরবে কাঁপে চারি ধার
সবে বলে , ‘পরিস্কার, অতি পরিস্কার!‘
দুর্বোধ যা-কিছু ছিল হয়ে গেল জল,
শূন্য আকাশের মতো অত্যন্ত নির্মল
হাঁপ ছাড়ি উঠিলেন হবুচন্দ্ররাজ,
আপনার মাথা হতে খুলি লয়ে তাজ
পরাইয়া দিল ক্ষীণ বাঙালির শিরে
ভারে তার মাথা টুকৃ পড়ে বুঝি ছিড়ে
বহু দিন পরে আজ চিন্তা গেল ছুটে,
হাবুডুবু হবুরাজ্য নড়িচড়ি ওঠে
ছেলেরা ধরিল খেলা, বৃদ্ধেরা তামুক-
এক দন্ডে খুলে গেল রমণীর মুখ
দেশ-জোড়া মাথা-ধরা ছেড়ে গেল চট্,
সবাই বুঝিয়া গেল-হিং টিং ছট্
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান।

যে শুনিবে এই স্বপ্ন মঙ্গলের কথা
সর্বভ্রম ঘুচে যবে, নহিবে অন্যথা
বিশ্বে কভূ বিশ্ব ভেবে হবে না ঠকিতে,
সত্যেরে সে মিথ্যা বলি বুঝিবে চকিতে
যা আছে তা নাই আর নাই যাহা আছে,
কথা জাজ্বল্যমান হবে তার কাছে
সবাই সরল ভাবে দেখিবে যা-কিছু
সে আপন লেজুড় জুড়িবে তার পিছু
এসো ভাই, তোল হাই, শুয়ে পড়ো চিত,
অনিশ্চিত সংসারে কথা নিশ্চিত
জগতে সকলেই মিথ্যা, সব মায়াময়,
স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয়
স্বপ্ন মঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান



==========================================================

সমালোচক

  ছোটদের ছড়া-কবিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বাবা নাকি বই লেখে সব নিজে
কিছুই বোঝা যায় না লেখেন কী যে!
সেদিন পড়ে শোনাচ্ছিলেন তোরে,
বুঝেছিলি? - বল্মা, সত্যি করে
এমন লেখায় তবে
বল্দেখি কী হবে।

তোর মুখে মা, যেমন কথা শুনি
তেমন কেন লেখেন নাকো উনি
ঠাকুরমা কি বাবাকে কক্খনো
রাজার কথা শোনায় নিকো কোনো?
সে-সব কথাগুলি
গেছেন বুঝি ভুলি?

স্নান করতে বেলা হল দেখে
তুমি কেবল যাও, মা, ডেকে ডেকে -
খাবার নিয়ে তুমি বসেই থাকো,
সে কথা তাঁর মনেই থাকে নাকো
করেন সারা বেলা
লেখা-লেখা খেলা।

বাবার ঘরে আমি খেলতে গেলে
তুমি আমায় বল 'দুষ্টু' ছেলে!
বকো আমায় গোল করলে পরে,
'দেখছিস নে লিখছে বাবা ঘরে!'
বল্তো, সত্যি বল্‌ ,
লিখে কী হয় ফল।

আমি যখন বাবার খাতা টেনে
লিখি বসে দোয়াত কলম এনে -
,
আমার বেলা কেন, মা, রাগ কর!
বাবা যখন লেখে
কথা কও না দেখে।

বড়ো বড়ো রুল-কাটা কাগোজ
নষ্ট বাবা করেন না কি রোজ?
আমি যদি নৌকো করতে চাই
অম্নি বল 'নষ্ট করতে নাই'
সাদা কাগজে কালো
করলে বুঝি ভালো ?


==========================================================

বিচার

ছোটদের ছড়া-কবিতা, সুকুমার রায়

ইঁদুর দেখে মাম্দো কুকুর বল্লে তেড়ে হেঁকে-
"বলব কি আর, বড়ই খুশি হলেম তোরে দেখে
আজকে আমার কাজ কিছু নেই, সময় আছে মেলা,
আয় না খেলি দুইজনাতে মোকদ্দমা খেলা
তুই হবি চোর তোর নামেতে করব নালিশ রুজু"-
"জজ্ কে হবে?" বল্লে ইঁদুর, বিষম ভয়ে জুজু,
"কোথায় উকিল প্যায়দা পুলিশ, বিচার কিসে হবে?"
মাম্দো বলে "তাও জানিসনে? শোন বলে দেই তবে!
আমিই হব উকিল হাকিম, আমিই হব জুরি,
কান ধরে তোর বলব ব্যাটা, ফের করেছিস চুরি?
সটান দেব ফাসির হুকুম অমনি একেবারে-
বুঝবি তখন চোর বাছাধন বিচার বলে কারে।"

==========================================================

পূজার সাজ


ছোটদের ছড়া-কবিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি,
পূজার সময় এল কাছে
মধু বিধু দুই ভাই ছুটাছুটি করে তাই
আনন্দে দু হাত তুলি নাচে

পিতা বসি ছিল দ্বারে ; দুজনে শুধালো তারে,
'কী পোশাক আনিয়াছ কিনে '
পিতা কহে, 'আছে আছে তোদের মায়ের কাছে,
দেখিতে পাইবি ঠিক দিনে '

সবুর সহে না আর - জননীরে বার বার
কহে, 'মা গো, ধরি তোর পায়ে,
বাবা আমাদের তরে কী কিনে এনেছে ঘরে
একবার দে-না, মা, দেখায়ে '
ব্যস্ত দেখি হাসিয়া মা দুখানি ছিটের জামা
দেখাইল করিয়া আদর
মধু কহে, 'আর নেই ?' মা কহিল, 'আছে এই
একজোড়া ধুতি চাদর '

রাগিয়া আগুন ছেলে - কাপড় ধুলায় ফেলে
কাঁদিয়া কহিল, 'চাহি না মা !
রায়বাবুদের গুপি পেয়েছে জরির টুপি
ফুলকাটা সাটিনের জামা '
মা কহিল, 'মধু, ছি ছি, কেন কাঁদ মিছামিছি !
গরিব যে তোমাদের বাপ
এবার হয় নি ধান, কত গেছে লোকসান,
পেয়েছেন কত দুঃখ তাপ
তবু দেখো বহু ক্লেশে তোমাদের ভালোবেসে
সাধ্যমত এনেছেন কিনে -
সে জিনিস অনাদরে ফেলিলি ধূলির 'পরে,
এই শিক্ষা হল এত দিনে !'

বিধু বলে, ' কাপড় পছন্দ হয়েছে মোর,
এই জামা পরাস আমারে !'
মধু শুনে আরো রেগে ঘর ছেড়ে দ্রুত বেগে
গেল রায়-বাবুদের দ্বারে
সেথা মেলা লোক জড়ো ; রায়বাবু ব্যস্ত বড়ো,
দালান সাজাতে গেছে রাত
মধু যবে এক কোণে দাঁড়াইল ম্লানমনে
চোখে তাঁর পড়িল হঠাৎ
কাছে ডাকি স্নেহভরে কহেন করুণ স্বরে
তারে দুই বাহুতে বাঁধিয়া,
'কী রে মধু, হয়েছে কী, তোরে যে শুকনো দেখি !'
শুনি মধু উঠিল কাঁদিয়া-
কহিল, 'আমার তরে বাবা আনিয়াছে ঘরে
শুধু এক ছিটের কাপড় !'
শুনি রায়-মহাশয় হাসিয়া মধুরে কয়,
'সেজন্য ভাবনা কিবা তোর !'
ছেলেরে ডাকিয়া চুপি কহিলেন, 'ওরে গুপি,
তোর জামা দে তুই মধুকে '
গুপির সে জামা পেয়ে মধু ঘরে যায় ধেয়ে,
হাসি আর নাহি ধরে মুখে

বুক ফুলাইয়া চলে, সবারে ডাকিয়া বলে,
'দেখো কাকা, দেখো চেয়ে মামা-
ওই আমাদের বিধু ছিট পরিয়াছে শুধু,
মোর গায়ে সাটিনের জামা '

মা শুনি কহেন আসি লাজে অশ্রুজলে ভাসি
কপালে করিয়া করাঘাত-
'হই দুঃখী হই দীন কাহারো রাখি না ঋণ,
কারো কাছে পাতি নাই হাত
তুমি আমাদেরি ছেলে ভিক্ষা লয়ে অবহেলে
অহংকার কর ধেয়ে ধেয়ে !
ছেঁড়া ধুতি আপনার ঢের বেশি দাম তার
ভিক্ষা-করা সাটিনের চেয়ে
আয় বিধু, আয় বুকে, চুমো খাই চাঁদমুখে-
তোর সাজ সব চেয়ে ভালো
দরিদ্র ছেলের দেহে দরিদ্র বাপের স্নেহে
ছিটের জামাটি করে আলো '

==========================================================

কাগজের নৌকা


ছোটদের ছড়া-কবিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ছুটি হলে রোজ ভাসাই জলে
কাগজ-নৌকাখানি
লিখে রাখি তাতে আপনার নাম,
লিখি আমাদের বাড়ি কোন গ্রাম
বড়ো বড়ো 'রে মোটা অক্ষরে
যতনে লাইন টানি
যদি সে নৌকা আর-কোনো দেশে
আর-কারো হাতে পড়ে গিয়ে শেষে
আমার লিখন পড়িয়া তখন
বুঝিবে সে অনুমানি
কার কাছ হতে ভেসে এল স্রোতে
কাগজ-নৌকাখানি ।।


আমার নৌকা সাজাই যতনে
শিউলি বকুলে ভরি
বাড়ির বাগানে গাছের তলায়
ছেয়ে থাকে ফুল সকাল বেলায়,
শিশিরের জল করে ঝলমল্
প্রভাতের আলো পড়ি
সেই কুসুমের অতি ছোটো বোঝা
কোন্দিক-পানে চলে যায় সোজা,
বেলাশেষে যদি পার হয়ে নদী
ঠেকে কোনোখানে যেয়ে -
প্রভাতের ফুল সাঁঝে পাবে কূল
কাগজের তরী বেয়ে ।।


আমার নৌকা ভাসাইয়া জলে
চেয়ে থাকি বসি তীরে
ছোটো ছোটো ঢেউ উঠে আর পড়ে,
রবির কিরণে ঝিকিমিকি করে,
আকাশেতে পাখি চলে যায় ডাকি,
বায়ু বহে ধীরে ধীরে
গগনের তলে মেঘ ভাসে কত
আমারি সে ছোটো নৌকার মতো -
কে ভাসালে তায়, কোথা ভেসে যায়,
কোন দেশে গিয়ে লাগে
মেঘ আর তরণী আমার
কে যাবে কাহার আগে ।।


বেলা হলে শেষে বাড়ি থেকে এসে
নিয়ে যায় মোরে টানি
আমি ঘরে ফিরি, থাকি কোনে মিশি,
যেথা কাটে দিন সেথা কাটে নিশি,
কোথা কোন্গাঁয় ভেসে চলে যায়
আমার নৌকাখানি
কোন্পথে যাবে কিছু নাই জানা,
কেহ তারে কভু নাহি করে মানা,
'রে নাহি রাখে, ফিরে নাহি ডাকে -
ধায় নব নব দেশে
কাগজের তরী, তারি 'পরে চড়ি
মন যায় ভেসে ভেসে ।।


রাত হয়ে আসে, শুই বিছানায়,
মুখ ঢাকি দুই হাতে -
চোখ বুঁজে ভাবি এমন আঁধার,
কালী দিয়ে ঢালা নদীর দুধার -
তারি মাঝখানে কোথায় কে জানে
নৌকা চলেছে রাতে
আকাশের তারা মিটি মিটি করে,
শিয়াল ডাকিছে প্রহরে প্রহরে,
তরীখানি বুঝি ঘর খুঁজি খুঁজি
তীরে তীরে ফিরে ভাসি
ঘুম লয়ে সাথে চড়েছে তাহাতে
ঘুম-পাড়ানিয়া মাসি ।।

==========================================================

বীরপুরুষ

  ছোটদের ছড়া-কবিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে
     মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ারপরে
     টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে
     রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে

     সন্ধে হল,সূর্য নামে পাটে
     এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে
ধূ ধূ করে যে দিক পানে চাই
কোনোখানে জনমানব নাই,
তুমি যেন আপনমনে তাই
     ভয় পেয়েছ; ভাবছ, এলেম কোথা?
আমি বলছি, ‘ভয় পেয়ো না মা গো,
     দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা

চোরকাঁটাতে মাঠ রয়েছে ঢেকে,
    মাঝখানেতে পথ গিয়েছে বেঁকে
গোরু বাছুর নেইকো কোনোখানে,
সন্ধে হতেই গেছে গাঁয়ের পানে,
আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে,
     অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে,
      ‘দিঘির ধারে যে কিসের আলো!’

     এমন সময় 'হারে রে রে রে রে
     যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে
তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে
ঠাকুর দেবতা স্মরণ করছ মনে,
বেয়ারাগুলো পাশের কাঁটাবনে
     পালকি ছেড়ে কাঁপছে থরোথরো
আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে,
     ‘আমি আছি, ভয় কেন মা কর।

হাতে লাঠি, মাথায় ঝাঁকড়া চুল
     কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল
আমি বলি, ‘দাঁড়া, খবরদার!
এক পা আগে আসিস যদি আর -
এই চেয়ে দেখ আমার তলোয়ার,
     টুকরো করে দেব তোদের সেরে
শুনে তারা লম্ফ দিয়ে উঠে
     চেঁচিয়ে উঠল, ‘হারে রে রে রে রে।

     তুমি বললে, ‘যাস না খোকা ওরে
     আমি বলি, ‘দেখো না চুপ করে।
ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম তাদের মাঝে,
ঢাল তলোয়ার ঝন্ঝনিয়ে বাজে
কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে,
     শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা
কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে,
     কত লোকের মাথা পড়ল কাটা

এত লোকের সঙ্গে লড়াই করে
     ভাবছ খোকা গেলই বুঝি মরে
আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে
বলছি এসে, ‘লড়াই গেছে থেমে’,
তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে
     চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে -
বলছ, ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল!
     কী দুর্দশাই হত তা না হলে।

     রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা -
     এমন কেন সত্যি হয় না আহা
ঠিক যেন এক গল্প হত তবে,
শুনত যারা অবাক হত সবে,
দাদা বলত, ‘কেমন করে হবে,
     খোকার গায়ে এত কি জোর আছে।
পাড়ার লোকে বলত সবাই শুনে,
      ‘ভাগ্যে খোকা ছিল মায়ের কাছে।

==========================================================

বিজ্ঞান শিক্ষা

  ছোটদের ছড়া-কবিতা, সুকুমার রায়

আয় তোর মুণ্ডুটা দেখি, আয় দেখি 'ফুটোস্কোপ' দিয়ে,
দেখি কত ভেজালের মেকি আছে তোর মগজের ঘিয়ে।
কোন দিকে বুদ্ধিটা খোলে, কোন দিকে থেকে যায় চাপা,
কতখানি ভস্ ভস্ ঘিলু, কতখানি ঠক্ঠকে ফাঁপা।
মন তোর কোন দেশে থাকে, কেন তুই ভুলে যাস্ কথা
আয় দেখি কোন ফাঁক দিয়ে, মগজেতে ফুটো তোর কোথা।
টোলখাওয়া ছাতাপড়া মাথা, ফাটামতো মনে হয় যেন,
আয় দেখি বিশ্লেষ 'রেচোপ্রাও ভয় পাস্ কেন?
কাৎ হয়ে কান 'রে দাঁড়া, জিভখানা উল্টিয়ে দেখা,
ভালো 'রে বুঝে শুনে দেখিবিজ্ঞানে যেরকম লেখা।
মুণ্ডুতে 'ম্যাগনেট' ফেলে, বাঁশ দিয়ে 'রিফ্লেক্' 'রে,
ইঁট দিয়ে 'ভেলসিটি' 'ষে দেখি মাথা ঘোরে কি না ঘোরে।




প্যাঁচা আর প্যাঁচানী

ছোটদের ছড়া-কবিতা, সুকুমার রায়

প্যাঁচা কয় প্যাঁচানী,
      
খাসা তোর চ্যাঁচানি
শুনে শুনে আন্মন
      
নাচে মোর প্রাণমন!
মাজাগলা চাঁচাসুর
      
আহলাদে ভরপুর!
গলাচেরা ধমকে
      
গাছ পালা চমকে,
সুরে সুরে কত প্যাঁচ
      
গিট্কিরি ক্যাঁচ্ ক্যাঁচ্!
যত ভয় যত দুখ
      
দুরু দুরু ধুক্ ধুক্,
তোর গানে পেঁচি রে
      
সব ভুলে গেছি রে,
চাঁদমুখে মিঠে গান
      
শুনে ঝরে দু'নয়ান৷

1 comment:

হট জোকস ১৮+