Thursday, April 7, 2016

=> রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর (৩২)

 

অটোগ্রাফ

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


খুলে আজ বলি , ওগো নব্য ,
নও তুমি পুরোপুরি সভ্য ।
জগৎটা যত লও চিনে
ভদ্র হতেছ দিনে দিনে ।
বলি তবু সত্য এ কথা —
বারো-আনা অভদ্রতা
কাপড়ে-চোপড়ে ঢাক ‘ তারে ,
ধরা তবু পড়ে বারে বারে ,
কথা যেই বার হয় মুখে
সন্দেহ যায় সেই চুকে ।
ডেস্কেতে দেখিলাম , মাতা
রেখেছেন অটোগ্রাফ-খাতা ।
আধুনিক রীতিটার ভানে
যেন সে তোমারই দাবি আনে ।
এ ঠকানো তোমার যে নয়
মনে মোর নাই সংশয় ।
সংসারে যারে বলে নাম
তার যে একটু নেই দাম
সে কথা কি কিছু ঢাকা আছে
শিশু ফিলজফারের কাছে ।
খোকা বলে , বোকা বলে কেউ —
তা নিয়ে কাঁদ না ভেউ-ভেউ ।
নাম-ভোলা খুশি নিয়ে আছ ,
নামের আদর নাহি যাচ ।
খাতাখানা মন্দ এ না গো
পাতা-ছেঁড়া কাজে যদি লাগ ।
আমার নামের অক্ষর
চোখে তব দেবে ঠোক্কর ।
ভাববে , এ বুড়োটার খেলা ,
আঁচড়-পাঁচড় কাটে মেলা ।
লজঞ্জুসের যত মূল্য
নাম মোর নহে তার তুল্য ।
তাই তো নিজেরে বলি , ধিক্ ,
তোমারই হিসাব-জ্ঞান ঠিক ।
বস্তু-অবস্তুর সেন্স্
খাঁটি তব , তার ডিফারেন্স্
পষ্ট তোমার কাছে খুবই —
তাই , হে লজঞ্জুস-লুভি ,
মতলব করি মনে মনে ,
খাতা থাক্ টেবিলের কোণে ।
বনমালী কো-অপেতে গেলে
টফি-চকোলেট যদি মেলে
কোনোমতে তবে অন্তত
মান রবে আজকের মতো ।
ছ বছর পরে নিয়ো খাতা ,
পোকায় না কাটে যদি পাতা ।

===============================================

অনন্ত প্রেম

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি
শত রূপে শত বার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়
গাঁথিয়াছে গীতহার,
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়,
নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।
যত শুনি সেই অতীত কাহিনী,
প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলনকথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে
দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া
তোমারি মুরতি এসে,
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।
আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি
যুগল প্রেমের স্রোতে
অনাদিকালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা
কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে,
মিলনমধুর লাজে—
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।
আজি সেই চিরদিবসের প্রেম
অবসান লভিয়াছে
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ,
নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে
সকল প্রেমের স্মৃতি—
সকল কালের সকল কবির গীতি।

===============================================

যাবার ‍ দিন

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই –
যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই।
এই জ্যোতিসমুদ্র মাঝে যে শতদল পদ্ম রাজে
তারি মধু পান করেছি, ধন্য আমি তাই।
যাবার দিনে এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই।।
বিশ্বরূপের খেলাঘরে কতই গেলেম খেলে,
অপরূপকে দেখে গেলেম দুটি নয়ন মেলে।
পরশ যাঁরে যায় না করা সকল দেহে দিলেন ধরা,
এইখানে শেষ করেন যদি শেষ করে দিন তাই –
যাবার বেলা এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই।।

===============================================

সোনার তোরী

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


গনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান-কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা–
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা॥
একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা—
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসী-মাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা—
এপারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা॥
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে!
দেখে যেন মনে হয়, চিনি উহারে।
ভরা পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু ধারে—
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে॥
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে?
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও—
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে॥
যত চাও তত লও তরণী-পরে।
আর আছে?— আর নাই, দিয়েছি ভরে॥
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে—
এখন আমারে লহো করুণা ক’রে॥
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহি নু পড়ি—
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী॥

===============================================

কন্যাবিদায়

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


জননী, কন্যারে আজ বিদায়ের ক্ষণে
আপন অতীতরূপ পড়িয়াছে মনে
যখন বালিকা ছিলে।
মাতৃক্রোড় হতে
তোমারে ভাসালো ভাগ্য দূরতর স্রোতে
সংসারের।
তার পর গেল কত দিন
দুঃখে সুখে,
বিচ্ছেদের ক্ষত হল ক্ষীণ।
এ-জন্মের আরম্ভভূমিকা-- সংকীর্ণ সে ।


===============================================

আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমার     খেলা যখন ছিল তোমার সনে
         তখন     কে তুমি তা কে জানত।
তখন     ছিল না ভয়, ছিল না লাজ মনে,
         জীবন     বহে যেত অশান্ত।
         তুমি     ভোরের বেলা ডাক দিয়েছ কত
               যেন আমার আপন সখার মতো,
         হেসে     তোমার সাথে ফিরেছিলাম ছুটে
               সেদিন    কত-না বন-বনান্ত।

ওগো,     সেদিন তুমি গাইতে যে সব গান
         কোনো     অর্থ তাহার কে জানত।
শুধু     সঙ্গে তারি গাইত আমার প্রাণ,
         সদা     নাচত হৃদয় অশান্ত।
         হঠাৎ     খেলার শেষে আজ কী দেখি ছবি -
               স্তব্ধ আকাশ, নীরব শশী রবি,
         তোমার     চরণপানে নয়ন করি নত
               ভুবন     দাঁড়িয়ে গেছে একান্ত।


===============================================

আমার মাঝে তোমার লীলা হবে

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমার মাঝে তোমার লীলা হবে,
তাই তো আমি এসেছি এই ভবে।
     এই ঘরে সব খুলে যাবে দ্বার,
     ঘুচে যাবে সকল অহংকার,
     আনন্দময় তোমার এ সংসার
          আমার কিছু আর বাকি না রবে।

মরে গিয়ে বাঁচব আমি, তবে
আমার মাঝে তোমার লীলা হবে।
     সব বাসনা যাবে আমার থেমে
     মিলে গিয়ে তোমারি এক প্রেমে,
     দুঃখসুখের বিচিত্র জীবনে
          তুমি ছাড়া আর কিছু না রবে।

===============================================

আমার সোনার বাংলা

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি ॥
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে--
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি ॥

কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো--
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে--
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি ॥

তোমার এই খেলাঘরে শিশুকাল কাটিলে রে,
তোমারি ধুলামাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি।
তুই দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে,
মরি হায়, হায় রে--
তখন খেলাধুলা সকল ফেলে, ও মা, তোমার কোলে ছুটে আসি ॥

ধেনু-চরা তোমার মাঠে, পারে যাবার খেয়াঘাটে,
সারা দিন পাখি-ডাকা ছায়ায়-ঢাকা তোমার পল্লীবাটে,
তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে,
মরি হায়, হায় রে--
ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই, ও মা, তোমার রাখাল তোমার চাষি ॥

ও মা, তোর চরণেতে দিলেম এই মাথা পেতে--
দে গো তোর পায়ের ধূলা, সে যে আমার মাথার মানিক হবে।
ও মা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে,
মরি হায়, হায় রে--
আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা, তোর ভূষণ ব'লে গলার ফাঁসি ॥


===============================================

আষাঢ়

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
     বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর,
     আউশের ক্ষেত জলে ভরভর,
কালি-মাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিছে দেখ্ চাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।।

ওই ডাকে শোনো ধেনু ঘনঘন, ধবলীরে আনো গোহালে।
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে।
     দুয়ারে দাঁড়ায়ে ওগো দেখ্ দেখি
     মাঠে গেছে যারা তারা ফিরিছে কি,
রাখালবালক কী জানি কোথায় সারা দিন আজি খোয়ালে।
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে।।

শোনো শোনো ওই পারে যাবে বলে কে ডাকিছে বুঝি মাঝিরে।
খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে।
     পুবে হাওয়া বয়, কূলে নেই কেউ,
     দু কূল বাহিয়া উঠে পড়ে ঢেউ,
দরদর বেগে জলে পড়ি জল ছলছল উঠে বাজি রে।
খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে।।

ওগো, আজ তোরা যাস নে গো, তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।
আকাশ আঁধার, বেলা বেশি আর নাহি রে।
     ঝরঝর ধারে ভিজিবে নিচোল,
     ঘাটে যেতে পথ হয়েছে পিছল,
ওই বেণুবন দুলে ঘনঘন পথপাশে দেখ্ চাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।।

===============================================

ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


নবীন, ওরে আমার কাঁচা,
ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।
রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে
আজকে যে যা বলে বলুক তোরে,
সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ ক’রে
পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা।
আয় দুরন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।

খাঁচাখানা দুলছে মৃদু হাওয়ায়;
আর তো কিছুই নড়ে না রে
ওদের ঘরে, ওদের ঘরের দাওয়ায়।
ওই যে প্রবীণ, ওই যে পরম পাকা,
চক্ষুকর্ণ দুইটি ডানায় ঢাকা,
ঝিমায় যেন চিত্রপটে আঁকা
অন্ধকারে বন্ধ করা খাঁচায়।
আয় জীবন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।

বাহিরপানে তাকায় না যে কেউ,
দেখে না যে বাণ ডেকেছে
জোয়ার-জলে উঠছে প্রবল ঢেউ।
চলতে ওরা চায় না মাটির ছেলে
মাটির ‘পরে চরণ ফেলে ফেলে,
আছে অচল আসনখানা মেলে
যে যার আপন উচ্চ বাঁশের মাচায়,
আয় অশান্ত, আয় রে আমার কাঁচা।

তোরে হেথায় করবে সবাই মানা।
হঠাৎ আলো দেখবে যখন
ভাববে এ কী বিষম কাণ্ডখানা।
সংঘাতে তোর উঠবে ওরা রেগে,
শয়ন ছেড়ে আসবে ছুটে বেগে,
সেই সুযোগে ঘুমের থেকে জেগে
লাগবে লড়াই মিথ্যা এবং সাঁচায়।
আয় প্রচণ্ড, আয় রে আমার কাঁচা।

শিকল-দেবীর ওই যে পূজাবেদী
চিরকাল কি রইবে খাড়া।
পাগলামি তুই আয় রে দুয়ার ভেদি।
ঝড়ের মাতন, বিজয়-কেতন নেড়ে
অট্টহাস্যে আকাশখানা ফেড়ে,
ভোলানাথের ঝোলাঝুলি ঝেড়ে
ভুলগুলো সব আন্‌ রে বাছা-বাছা।
আয় প্রমত্ত, আয় রে আমার কাঁচা।

আন্‌ রে টেনে বাঁধা-পথের শেষে।
বিবাগী কর্‌ অবাধপানে,
পথ কেটে যাই অজানাদের দেশে।
আপদ আছে, জানি অঘাত আছে,
তাই জেনে তো বক্ষে পরান নাচে,
ঘুচিয়ে দে ভাই পুঁথি-পোড়োর কাছে
পথে চলার বিধিবিধান যাচা।
আয় প্রমুক্ত, আয় রে আমার কাঁচা।

চিরযুবা তুই যে চিরজীবী,
জীর্ণ জরা ঝরিয়ে দিয়ে
প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দেদার দিবি।
সবুজ নেশায় ভোর করেছি ধরা,
ঝড়ের মেঘে তোরি তড়িৎ ভরা,
বসন্তেরে পরাস আকুল-করা
আপন গলার বকুল-মাল্যগাছা,
আয় রে অমর, আয় রে আমার কাঁচা।


===============================================

কাগজের নৌকা

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


ছুটি হলে রোজ ভাসাই জলে
কাগজ-নৌকাখানি।
লিখে রাখি তাতে আপনার নাম,
লিখি আমাদের বাড়ি কোন গ্রাম
বড়ো বড়ো ক'রে মোটা অক্ষরে
যতনে লাইন টানি।
যদি সে নৌকা আর-কোনো দেশে
আর-কারো হাতে পড়ে গিয়ে শেষে
আমার লিখন পড়িয়া তখন
বুঝিবে সে অনুমানি
কার কাছ হতে ভেসে এল স্রোতে
কাগজ-নৌকাখানি ।।


আমার নৌকা সাজাই যতনে
শিউলি বকুলে ভরি।
বাড়ির বাগানে গাছের তলায়
ছেয়ে থাকে ফুল সকাল বেলায়,
শিশিরের জল করে ঝলমল্‌
প্রভাতের আলো পড়ি।
সেই কুসুমের অতি ছোটো বোঝা
কোন্‌ দিক-পানে চলে যায় সোজা,
বেলাশেষে যদি পার হয়ে নদী
ঠেকে কোনোখানে যেয়ে -
প্রভাতের ফুল সাঁঝে পাবে কূল
কাগজের তরী বেয়ে ।।


আমার নৌকা ভাসাইয়া জলে
চেয়ে থাকি বসি তীরে।
ছোটো ছোটো ঢেউ উঠে আর পড়ে,
রবির কিরণে ঝিকিমিকি করে,
আকাশেতে পাখি চলে যায় ডাকি,
বায়ু বহে ধীরে ধীরে ।
গগনের তলে মেঘ ভাসে কত
আমারি সে ছোটো নৌকার মতো -
কে ভাসালে তায়, কোথা ভেসে যায়,
কোন দেশে গিয়ে লাগে।
ঐ মেঘ আর তরণী আমার
কে যাবে কাহার আগে ।।


বেলা হলে শেষে বাড়ি থেকে এসে
নিয়ে যায় মোরে টানি
আমি ঘরে ফিরি, থাকি কোনে মিশি,
যেথা কাটে দিন সেথা কাটে নিশি,
কোথা কোন্‌ গাঁয় ভেসে চলে যায়
আমার নৌকাখানি ।
কোন্‌ পথে যাবে কিছু নাই জানা,
কেহ তারে কভু নাহি করে মানা,
ধ'রে নাহি রাখে, ফিরে নাহি ডাকে -
ধায় নব নব দেশে।
কাগজের তরী, তারি 'পরে চড়ি
মন যায় ভেসে ভেসে ।।


রাত হয়ে আসে, শুই বিছানায়,
মুখ ঢাকি দুই হাতে -
চোখ বুঁজে ভাবি এমন আঁধার,
কালী দিয়ে ঢালা নদীর দুধার -
তারি মাঝখানে কোথায় কে জানে
নৌকা চলেছে রাতে।
আকাশের তারা মিটি মিটি করে,
শিয়াল ডাকিছে প্রহরে প্রহরে,
তরীখানি বুঝি ঘর খুঁজি খুঁজি
তীরে তীরে ফিরে ভাসি।
ঘুম লয়ে সাথে চড়েছে তাহাতে
ঘুম-পাড়ানিয়া মাসি ।।


===============================================

কৃষ্ণকলি

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,  
        কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
মেঘলাদিনে দেখেছিলেম মাঠে  
        কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিলনা তার মোটে,  
মুক্তবেণী পিঠের 'পরে লোটে।
        কালো? তা সে যতই কালো হোক,  
        দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে  
        ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,
শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে  
        কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।
আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু  
শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।
        কালো? তা সে যতই কালো হোক,  
        দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

পূবে বাতাস এল হঠাত্‍‌ ধেয়ে,
        ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।
আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা,
        মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।
আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে,
আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে।
        কালো? তা সে যতই কালো হোক,
        দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

এমনি করে কাজল কালো মেঘ  
        জ্যৈষ্ঠমাসে আসে ঈশান কোণে।
এমনি করে কালো কোমল ছায়া
        আষাঢ়মাসে নামে তমাল-বনে।
এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে
হঠাত্‍‌ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।
        কালো? তা সে যতই কালো হোক,
        দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,  
        আর যা বলে বলুক অন্য লোক।
দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে
        কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
মাথার পরে দেয়নি তুলে বাস,
লজ্জা পাবার পায়নি অবকাশ।
        কালো? তা সে যতই কালো হোক,
        দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ। 

===============================================

ক্ষণিকা

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


খোলো খোলো, হে আকাশ, স্তব্ধ তব নীল যবনিকা -
খুঁজে নিতে দাও সেই আনন্দের হারানো কণিকা।
কবে সে যে এসেছিল আমার হৃদয়ে যুগান্তরে
গোধূলিবেলার পান্থ জনশূন্য এ মোর প্রান্তরে
     লয়ে তার ভীরু দীপশিখা!
দিগন্তের কোন্ পারে চলে গেল আমার ক্ষণিকা।।


===============================================

ছল

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


তোমারে পাছে সহজে বুঝি     তাই কি এত লীলার ছল -
বাহিরে যবে হাসির ছটা     ভিতরে থাকে আঁখির জল।
বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব     ছলনা -
যে কথা তুমি বলিতে চাও     সে কথা তুমি বল না।।

তোমারে পাছে সহজে ধরি     কিছুরই তব কিনারা নাই -
দশের দলে টানি গো পাছে     কিরূপ তুমি, বিমুখ তাই।
বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব     ছলনা -
যে পথে তুমি চলিতে চাও     সে পথে তুমি চল না।।

সবার চেয়ে অধিক চাহ,     তাই কি তুমি ফিরিয়া যাও -
হেলার ভরে খেলার মতো     ভিক্ষাঝুলি ভাসায়ে দাও?
বুঝেছি আমি, বুজেছি তব     ছলনা -
সবার যাহে তৃপ্তি হল     তোমার তাহে হল না।।

===============================================

জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ
বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছলজলধিতরঙ্গ
তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিষ মাগে,
গাহে তব জয়গাথা।
জনগণমঙ্গলদায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।

অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী
হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী
পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশে
প্রেমহার হয় গাঁথা।
জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।

পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী।
হে চিরসারথি, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিনরাত্রি।
দারুণ বিপ্লব-মাঝে তব শঙ্খধ্বনি বাজে
সঙ্কটদুঃখত্রাতা।
জনগণপথপরিচায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।

ঘোরতিমিরঘন নিবিড় নিশীথে পীড়িত মূর্ছিত দেশে
জাগ্রত ছিল তব অবিচল মঙ্গল নতনয়নে অনিমেষে।
দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে রক্ষা করিলে অঙ্কে
স্নেহময়ী তুমি মাতা।
জনগণদুঃখত্রায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।

রাত্রি প্রভাতিল, উদিল রবিচ্ছবি পূর্ব-উদয়গিরিভালে –
গাহে বিহঙ্গম, পূণ্য সমীরণ নবজীবনরস ঢালে।
তব করুণারুণরাগে নিদ্রিত ভারত জাগে
তব চরণে নত মাথা।
জয় জয় জয় হে জয় রাজেশ্বর ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।।

===============================================

ঝুলন

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমি   পরানের সাথে খেলিব আজিকে মরণখেলা
             নিশীথবেলা।
      সঘন বরষা, গগন আঁধার
      হেরো বারিধারে কাঁদে চারিধার---
      ভীষণ রঙ্গে ভবতরঙ্গে ভাসাই ভেলা;
      বাহির হয়েছি স্বপ্নশয়ন করিয়া হেলা
             রাত্রিবেলা॥

ওগো,   পবনে গগনে সাগরে আজিকে কী কল্লোল!
             দে দোল্ দোল্।
      পশ্চাত্‍‌ হতে হাহা ক'রে হাসি
      মত্ত ঝটিকা ঠেলা দেয় আসি,
      যেন এ লক্ষ যক্ষশিশুর অট্টরোল।
      আকাশে পাতালে পাগলে মাতালে হট্টগোল!
             দে দোল্ দোল্।

আজি   জাগিয়া উঠিয়া পরান আমার বসিয়া আছে
             বুকের কাছে।
      থাকিয়া থাকিয়া উঠিছে কাঁপিয়া,
      ধরিছে আমার বক্ষ চাপিয়া,
      নিঠুর নিবিড় বন্ধনসুখে হৃদয় নাচে;
      ত্রাসে উল্লাসে পরান আমার ব্যাকুলিয়াছে
             বুকের কাছে॥

হায়,   এতকাল আমি রেখেছিনু তারে যতনভরে
             শয়ন-'পরে।
      ব্যথা পাছে লাগে---- দুখ পাছে জাগে
      নিশিদিন তাই বহু অনুরাগে
      বাসরশয়ন করেছি রচন কুসুমথরে;
      দুয়ার রুধিয়া রেখেছিনু তারে গোপন ঘরে
             যতনভরে॥

কত    সোহাগ করেছি চুম্বন করি নয়নপাতে
             স্নেহের সাথে।
      শুনায়েছি তারে মাথা রাখি পাশে
      কত প্রিয়নাম মৃদুমধুভাষে,
      গুঞ্জরতান করিয়াছি গান জ্যোত্‍‌স্নারাতে;
      যা-কিছু মধুর দিয়েছিনু তার দুখানি হাতে
             স্নেহের সাথে॥

শেষে   সুখের শয়নে শ্রান্ত পরান আলসরসে
             আবেশবশে।
      পরশ করিলে জাগে না সে আর,
      কুসুমের হার লাগে গুরুভার,
      ঘুমে, জাগরণে মিশি একাকার নিশিদিবসে
      বেদনাবিহীন অসাড় বিরাগ মরমে পশে
             আবেশবশে॥

ঢালি   মধুরে মধুর বধূরে আমার হারাই বুঝি,
             পাই নে খুঁজি।
      বাসরের দীপ নিবে নিবে আসে,
      ব্যাকুল নয়ন হেরি চারি পাশে
      শুধু রাশি রাশি শুষ্ক কুসুম হয়েছে পুঁজি;
      অতল স্বপ্নসাগরে ডুবিয়া মরি যে যুঝি
             কাহারে খুঁজি॥

তাই   ভেবেছি আজিকে খেলিতে হইবে নূতন খেলা
             রাত্রিবেলা
      মরণদোলায় ধরি রশিগাছি
      বসিব দুজনে বড়ো কাছাকাছি,
      ঝঞ্ঝা আসিয়া অট্ট হাসিয়া মারিবে ঠেলা;
      আমাতে প্রাণেতে খেলিব দুজনে ঝুলনখেলা
             নিশীথবেলা॥

           দে দোল্ দোল্।
           দে দোল্ দোল্।
         এ মহাসাগরে তুফান তোল্
      বধূরে আমার পেয়েছি আবার, ভরেছে কোল।
      প্রিয়ারে আমার তুলেছে জাগায়ে প্রলয়রোল।
      বক্ষশোণিতে উঠেছে আবার কী হিল্লোল!
      ভিতরে বাহিরে জেগেছে আমার কী কল্লোল!
         উড়ে কুন্তল, উড়ে অঞ্চল,
         উড়ে বনমালা বায়ুচঞ্চল,
      বাজে কঙ্কণ বাজে কিঙ্কিণী--- মত্তরোল।
             দে দোল্ দোল্।

      আয় রে ঝঞ্ঝা, পরানবধূর
      আবরণরাশি করিয়া দে দূর,
      করি লুণ্ঠন অবগুণ্ঠন-বসন খোল্।
             দে দোল্ দোল্।

      প্রাণেতে আমাতে মুখোমুখি আজ
      চিনি লব দোঁহে ছাড়ি ভয়-লাজ,
      বক্ষে বক্ষে পরশিব দোঁহে ভাবে বিভোল।
             দে দোল্ দোল্।
      স্বপ্ন টুটিয়া বাহিরিছে আজ দুটি পাগল।
             দে দোল্ দোল্।


===============================================

যেদিন ফুটল কমল কিছুই জানি নাই

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


যেদিন ফুটল কমল কিছুই জানি নাই
  আমি ছিলেম অন্যমনে |
আমার সাজিয়ে সাজি তারে আনি নাই
  সে যে রইল সঙ্গোপনে |
         মাঝে মাঝে হিয়া আকুলপ্রায়
         স্বপন দেখে চম্ কে উঠে চায়,
         মন্দ মধুর গন্ধ আসে হায়
  কোথায় দখিন সমীরণে |

ওগো সেই সুগন্ধে ফিরায় উদাসিয়া
             আমায় দেশে দেশান্তে |
যেন সন্ধানে তার উঠে নিঃশ্বাসিয়া
             ভুবন নবীন বসন্তে |
        কে জানিত দূরে ত নেই সে
        আমারি গো আমারি সেই যে,
        এ মাধুরী ফুটেছে হায়রে
আমার হৃদয় উপবনে |


===============================================

তালগাছ

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


তালগাছ        এক পায়ে দাঁড়িয়ে
                      সব গাছ ছাড়িয়ে
                            উঁকি মারে আকাশে।
মনে সাধ,      কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়
                      একেবারে উড়ে যায়;
                            কোথা পাবে পাখা সে?
তাই তো সে    ঠিক তার মাথাতে
                      গোল গোল পাতাতে
                            ইচ্ছাটি মেলে তার,--
মনে মনে       ভাবে, বুঝি ডানা এই,
                      উড়ে যেতে মানা নেই
                            বাসাখানি ফেলে তার।
সারাদিন       ঝরঝর থত্থর
                      কাঁপে পাতা-পত্তর,
                            ওড়ে যেন ভাবে ও,
মনে মনে       আকাশেতে বেড়িয়ে
                      তারাদের এড়িয়ে
                            যেন কোথা যাবে ও।
তার পরে       হাওয়া যেই নেমে যায়,
                      পাতা-কাঁপা থেমে যায়,
                            ফেরে তার মনটি
যেই ভাবে,     মা যে হয় মাটি তার
                      ভালো লাগে আরবার
                            পৃথিবীর কোণটি।


===============================================

দুই বিঘা জমি

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, 'বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।'
কহিলাম আমি, 'তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই -
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই।
শুনি রাজা কহে, 'বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা,
পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা -
ওটা দিতে হবে।' কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে, 'করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি।
সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!'
আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে,
কহিলেন শেষে ক্রুর হাসি হেসে, 'আচ্ছা, সে দেখা যাবে।'

পরে মাস-দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে -
করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।
এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি,
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
মনে ভাবিলাম, মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে,
তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে।
সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য -
কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য।
ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি
তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি।
হাটে মাঠে বাটে এইমত কাটে বছর পনেরো-ষোলো,
একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়োই বাসনা হল।।

নমোনমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধুলি -
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।
পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগেহ -
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল নিশীথশীতলস্নেহ।
বুক-ভরা-মধু বঙ্গের বধু জল লয়ে যায় ঘরে
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।
দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে -
কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি, রথতলা করি বামে,
রাখি হাটখোলা নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছে
তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে।।

ধিক্ ধিক্ ওরে, শত ধিক্ তোরে নিলাজ কুলটা ভূমি,
যখনি যাহার তখনি তাহার - এই কি জননী তুমি!
সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা
আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফলফুল শাক-পাতা!
আজ কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ -
পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ!
আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন,
তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী, হাসিয়া কাটাস দিন!
ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন -
কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সে দিনের কোনো চিহ্ন!
কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ী, ক্ষুধাহরা সুধারাশি।
যত হাসো আজ, যত করো সাজ, ছিলে দেবী - হলে দাসী।।

বিদীর্ণহিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি -
প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে সেই আমগাছ একি!
বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা,
একে একে মনে উদিল স্মরণে বালককালের কথা।
সেই মনে পড়ে, জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম,
অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন -
ভাবিলাম হায়, আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন।
সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে,
দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে।
ভাবিলাম মনে, বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা।
স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা।।

হেনকালে হায় যমদূতপ্রায় কোথা হতে এল মালী।
ঝুঁটিবাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি।
কহিলাম তবে, 'আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব -
দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব।'
চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ;
বাবু ছিপ হাতে পারিষদ-সাথে ধরিতেছিলেন মাছ -
শুনে বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, 'মারিয়া করিব খুন।'
বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ।
আমি কহিলাম, 'শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়!'
বাবু কহে হেসে, 'বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়!'
আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোরে ঘটে -
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।।


===============================================

দায়মোচন

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


চিরকাল রবে মোর প্রেমের কাঙাল,
     এ কথা বলিতে চাও বোলো।
এই ক্ষণটুকু হোক সেই চিরকাল -
     তার পরে যদি তুমি ভোল
মনে করাব না আমি শপথ তোমার,
আসা যাওয়া দু দিকেই খোলা রবে দ্বার -
যাবার সময় হলে যেয়ো সহজেই,
     আবার আসিতে হয় এসো।
সংশয় যদি রয় তাহে ক্ষতি নেই,
     তবু ভালোবাস যদি বেসো।।

বন্ধু, তোমার পথ সম্মুখে জানি,
     পশ্চাতে আমি আছি বাঁধা।
অশ্রুনয়নে বৃথা শিরে কর হানি
     যাত্রায় নাহি দিব বাধা।
আমি তব জীবনের লক্ষ্য তো নহি,
ভুলিতে ভুলিতে যাবে হে চিরবিরহী,
তোমার যা দান তাহা রহিবে নবীন
     আমার স্মৃতির আঁখিজলে -
আমার যা দান সেও জেনো চিরদিন
     রবে তব বিস্মৃতিতলে।।

দূরে চলে যেতে যেতে দ্বিধা করি মনে
     যদি কভু চেয়ে দেখ ফিরে,
হয়তো দেখিবে আমি শূন্য শয়নে -
     নয়ন সিক্ত আঁখিনীরে।
মার্জনা কর যদি পাব তবে বল,
করুণা করিলে নাহি ঘোচে আঁখিজল -
সত্য যা দিয়েছিলে থাক্ মোর তাই,
     দিবে লাজ তার বেশি দিলে।
দুঃখ বাঁচাতে যদি কোনোমতে চাই
     দুঃখের মূল্য না মিলে।।

দুর্বল ম্লান করে নিজ অধিকার
     বরমাল্যের অপমানে।
যে পারে সহজে নিতে যোগ্য সে তার,
     চেয়ে নিতে সে কভু না জানে।
প্রেমেরে বাড়াতে গিয়ে মিশাব না ফাঁকি,
সীমারে মানিয়া তার মর্যাদা রাখি -
যা পেয়েছি সেই মোর অক্ষয় ধন,
     যা পাই নি বড়ো সেই নয়।
চিত্ত ভরিয়া রবে ক্ষণিক মিলন
     চিরবিচ্ছেদ করি জয়।।

===============================================

দুর্ভাগা দেশ

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
              মানুষের অধিকারে
              বঞ্চিত করেছ যারে,
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।

মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে
ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে।
              বিধাতার রুদ্ররোষে
              দুর্ভিক্ষের-দ্বারে বসে
ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান।
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।

তোমার আসন হতে যেথায় তাদের দিলে ঠেলে
সেথায় শক্তিরে তব নির্বাসন দিলে অবহেলে।
              চরণে দলিত হয়ে
              ধূলায় সে যায় বয়ে -
সেই নিম্নে নেমে এসো, নহিলে নাহি রে পরিত্রাণ।
অপমানে হতে হবে আজি তোরে সবার সমান।

যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে,
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
              অজ্ঞানের অন্ধকারে
              আড়ালে ঢাকিছ যারে
তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।

শতেক শতাব্দী ধরে নামে শিরে অসম্মানভার,
মানুষের নারায়ণে তবুও কর না  নমস্কার।
              তবু নত করি আঁখি
              দেখিবার পাও না কি
নেমেছে ধূলার তলে হীনপতিতের ভগবান।
অপমানে হতে হবে সেথা তোরে সবার সমান।

দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে -
অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকারে।
              সবারে না যদি ডাকো,
              এখনো সরিয়া থাকো,
আপনারে বেঁধে রাখো চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান -
মৃত্যু-মাঝে হবে তবে চিতাভস্মে সবার সমান। 



===============================================

নিদ্রিতা

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


একদা রাতে নবীন যৌবনে
               স্বপ্ন হতে উঠিনু চমকিয়া,
বাহিরে এসে দাঁড়ানু একবার---
               ধরার পানে দেখিনু নিরখিয়া ।
শীর্ণ হয়ে এসেছে শুকতারা,
               পূর্বতটে হতেছে নিশিভোর ।
আকাশকোণে বিকাশে জাগরণ,
               ধরণীতলে ভাঙে নি ঘুমঘোর ।
সমুখে প'ড়ে দীর্ঘ রাজপথ,
               দু ধারে তারি দাঁড়ায়ে তরুসার,
নয়ন মেলি সুদূর-পানে চেয়ে
               আপন-মনে ভাবিনু একবার---
অরুণ-রাঙা আজি এ নিশিশেষে
               ধরার মাঝে নূতন কোন্ দেশে
দুগ্ধফেনশয়ন করি আলা
               স্বপ্ন দেখে ঘুমায়ে রাজবালা ।।

অশ্ব চড়ি তখনি বাহিরিনু,
               কত যে দেশ বিদেশ হনু পার !
একদা এক ধূসরসন্ধ্যায়
               ঘুমের দেশে লভিনু পুরদ্বার ।
সবাই সেথা অচল অচেতন,
               কোথাও জেগে নাইকো জনপ্রাণী,
নদীর তীরে জলের কলতানে
               ঘুমায়ে আছে বিপুল পুরীখানি ।
ফেলিতে পদ সাহস নাহি মানি,
               নিমেষে পাছে সকল দেশ জাগে ।
প্রাসাদ মাঝে পশিনু সাবধানে,
               শঙ্কা মোর চলিল আগে আগে ।
ঘুমায় রাজা, ঘুমায় রানীমাতা,
               কুমার-সাথে ঘুমায় রাজভ্রাতা ।
একটি ঘরে রত্নদীপ জ্বালা,
               ঘুমায়ে সেথা রয়েছে রাজবালা ।।
কমলফুল বিমল শেজখানি,
               নিলীন তাহে কোমল তনুলতা ।
মুখের পানে চাহিনু অনিমেষে,
               বাজিল বুকে সুখের মত ব্যাথা ।
মেঘের মত গুচ্ছ কেশরাশি
               শিথান ঢাকি পড়েছে ভারে ভারে ।
একটি বাহু বক্ষ-'পরে পড়ি,
               একটি বাহু লুটায় এক ধারে ।
আঁচলখানি পড়েছে খসি পাশে,
               কাঁচলখানি পড়িবে বুঝি টুটি---
পত্রপুটে রয়েছে যেন ঢাকা
               অনাঘ্রাত পূজার ফুল দুটি ।
দেখিনু তারে, উপমা নাহি জানি---
               ঘুমের দেশে স্বপন একখানি,
পালঙ্কেতে মগন রাজবালা
               আপন ভরা লাবণ্যে নিরালা ।।

ব্যাকুল বুকে চাপিনু দুই বাহু,
               না মানে বাধা হৃদয়কম্পন ।
ভূতলে বসি আনত করি শির
               মুদিত আঁখি করিনু চুম্বন ।
পাতার ফাঁকে আঁখির তারা দুটি,
               তাহারি পানে চাহিনু একমনে---
দ্বারের ফাঁকে দেখিতে চাহি যেন
               কী আছে কোথা নিভৃত নিকেতনে ।
ভূর্জপাতে কাজলমসী দিয়ে
               লিখিয়া দিনু আপন নামধাম ।
লিখিনু, 'অয়ি নিদ্রানিমগনা,
               আমার প্রাণ তোমারে সঁপিলাম ।'
যতন করে কনক-সুতে গাঁথি
               রতন-হারে বাঁধিয়া দিনু পাঁতি---
ঘুমের দেশে ঘুমায়ে রাজবালা,
               তাহারি গলে পরায়ে দিনু মালা ।।

===============================================

নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


আজি এ প্রভাতে প্রভাতবিহগ
        কী গান গাইল রে!
অতিদূর দূর আকাশ হইতে
       ভাসিয়া আইল রে!
না জানি কেমনে পশিল হেথায়
       পথহারা তার একটি তান,
    আঁধার গুহায় ভ্রমিয়া ভ্রমিয়া
    গভীর গুহায় নামিয়া নামিয়া
    আকুল হইয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া
       ছুঁয়েছে আমার প্রাণ।
আজি এ প্রভাতে সহসা কেন রে
       পথহারা রবিকর
আলয় না পেয়ে পড়েছে আসিয়ে
       আমার প্রাণের ‘পর!
বহুদিন পরে একটি কিরণ
       গুহায় দিয়েছে দেখা,
পড়েছে আমার আঁধার সলিলে
       একটি কনকরেখা।
    প্রাণের আবেগ রাখিতে নারি
    থর থর করি কাঁপিছে বারি,
    টলমল জল করে থল থল,
    কল কল করি ধরেছে তান।
আজি এ প্রভাতে কী জানি কেন রে
       জাগিয়া উঠেছে প্রাণ।
    জাগিয়া দেখিনু, চারিদিকে মোর
    পাষাণে রচিত কারাগার ঘোর,
বুকের উপরে আঁধার বসিয়া
       করিছে নিজের ধ্যান।
না জানি কেন রে এতদিন পরে
       জাগিয়া উঠেছে প্রাণ।
জাগিয়া দেখিনু আমি আঁধারে রয়েছি আঁধা,
আপনারি মাঝে আমি আপনি রয়েছি বাঁধা।
রয়েছি মগন হয়ে আপনারি কলস্বরে,
ফিরে আসে প্রতিধ্বনি নিজেরি শ্রবণ-’পরে।
দূর দূর দূর হতে ভেদিয়া আঁধার কারা
মাঝে মাঝে দেখা দেয় একটি সন্ধ্যার তারা।
তারি মুখ দেখে দেখে আঁধার হাসিতে শেখে,
তারি মুখ চেয়ে চেয়ে করে নিশি অবসান।
শিহরি উঠে রে বারি,দোলে রে দোলে রে প্রাণ,
প্রাণের মাঝারে ভাসি দোলে রে দোলে রে হাসি,
দোলে রে প্রাণের ‘পরে আশার স্বপন মম,
দোলে রে তারার ছায়া সুখের আভাস-সম।

মাঝে মাঝে একদিন আকাশেতে নাই আলো,
পড়িয়া মেঘের ছায়া কালো জল হয় কালো।
আঁধার সলিল- ‘পরে ঝর ঝর বারি ঝরে
ঝর ঝর ঝর ঝর,দিবানিশি অবিরল--
বরষার দুখ-কথা,বরষার আঁখিজল।
শুয়ে শুয়ে আনমনে দিবানিশি তাই শুনি
একটি একটি ক’রে দিবানিশি তাই গুনি,
তারি সাথে মিলাইয়া কল কল গান গাই--
ঝর ঝর কল কল--দিন নাই, রাত নাই।
এমনি নিজেরে লয়ে রয়েছি নিজের কাছে,
আঁধার সলিল -‘পরে আঁধার জাগিয়া আছে।
এমনি নিজের কাছে খুলেছি নিজের প্রাণ,
এমনি পরের কাছে শুনেছি নিজের গান।

       আজি এ প্রভাতে রবির কর
       কেমনে পশিল প্রাণের ‘পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে
       প্রভাত-পাখির গান।
না জানি কেন রে এতদিন পরে
       জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
       জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
ওরে উথলি উঠেছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ
       রুধিয়া রাখিতে নারি।
থর থর করি কাঁপিছে ভূধর,
শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে,
ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল
গরজি উঠিছে দারুণ রোষে।
হেথায় হোথায় পাগলের প্রায়
ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায়,
বাহিরিতে চায়, দেখিতে না পায়
          কোথায় কারার দ্বার।
প্রভাতেরে যেন লইতে কাড়িয়া
আকাশেরে যেন ফেলিতে ছিঁড়িয়া
উঠে শূন্যপানে---পড়ে আছাড়িয়া
করে শেষে হাহাকার।
প্রাণের উল্লাসে ছুটিতে চায়
ভূধরের হিয়া টুটিতে চায়,
আলিঙ্গন তরে ঊর্ধ্বে বাহু তুলি
আকাশের পানে উঠিতে চায়।

প্রভাতকিরণে পাগল হইয়া
জগৎ-মাঝারে লুটিতে চায়।
কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন,
চারি দিকে তার বাঁধন কেন?
ভাঙ্‌ রে হৃদয় ভাঙ্‌ রে বাঁধন,
সাধ্‌ রে আজিকে প্রাণের সাধন,
লহরীর পরে লহরী তুলিয়া
আঘাতের পর আঘাত কর।
মাতিয়া যখন উঠিছে পরান
কিসের আঁধার, কিসের পাষাণ !

উথলি যখন উঠিছে বাসনা,
জগতে তখন কিসের ডর!

সহসা আজি এ জগতের মুখ
       নূতন করিয়া দেখিনু কেন?
একটি পাখির আধখানি তান
       জগতের গান গাহিল যেন!
জগৎ দেখিতে হইব বাহির
       আজিকে করেছি মনে,
দেখিব না আর নিজেরি স্বপন
       বসিয়া গুহার কোণে।
আমি ঢালিব করুণাধারা,
আমি ভাঙিব পাষাণকারা,
আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া
       আকুল পাগল-পারা;
কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া,
রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া,
রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া,
       দিব রে পরান ঢালি।
শিখর হইতে শিখরে ছুটিব,
ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব
হেসে খলখল গেয়ে কলকল
       তালে তালে দিব তালি।
তটিনী হইয়া যাইব বহিয়া--
যাইব বহিয়া--যাইব বহিয়া--
হৃদয়ের কথা কহিয়া কহিয়া
       গাহিয়া গাহিয়া গান,
যত দেব প্রাণ বহে যাবে প্রাণ
       ফুরাবে না আর প্রাণ।
এত কথা আছে এত গান আছে
       এত প্রাণ আছে মোর,
এত সুখ আছে এত সাধ আছে
প্রাণ হয়ে আছে ভোর।

এত সুখ কোথা এত রূপ কোথা
       এত খেলা কোথা আছে!
যৌবনের বেগে বহিয়া যাইব
       কে জানে কাহার কাছে!
অগাধ বাসনা অসীম আশা
       জগৎ দেখিতে চাই!
জাগিয়াছে সাধ চরাচরময়
       প্লাবিয়া বহিয়া যাই।
       যত প্রাণ আছে ঢালিতে পারি,
       যত কাল আছে বহিতে পারি,
       যত দেশ আছে ডুবাতে পারি,
          তবে আর কিবা চাই!
          পরানের সাধ তাই।

কী জানি কী হল আজি জাগিয়া উঠিল প্রাণ,
দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান--
‘পাষাণ-বাঁধন টুটি, ভিজায়ে কঠিন ধরা,
বনেরে শ্যামল করি, ফুলেরে ফুটায়ে ত্বরা,
       সারাপ্রাণ ঢালি দিয়া,
       জুড়ায়ে জগৎ-হিয়া--
আমার প্রাণের মাঝে কে আসিবি আয় তোরা!’

আমি যাব, আমি যাব, কোথায় সে, কোন্‌ দেশ--
       জগতে ঢালিব প্রাণ,
       গাহিব করুণাগান,
       উদ্‌বেগ-অধীর হিয়া
       সুদূর সমুদ্রে গিয়া
সে প্রাণ মিশাব আর সে গান করিব শেষ।

       ওরে, চারি দিকে মোর
       এ কী কারাগার ঘোর !
ভাঙ্‌ ভাঙ্‌ ভাঙ্‌ কারা, আঘাতে আঘাত কর্ !
       ওরে,আজ কী গান গেয়েছে পাখি,
          এয়েছে রবির কর ! 



===============================================

পুরাতন ভৃত্য

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


ভূতের মতন চেহারা যেমন,   নির্বোধ অতি ঘোর—
যা‐কিছু হারায়, গিন্নি বলেন,   “কেষ্টা বেটাই চোর।”
উঠিতে বসিতে করি বাপান্ত,   শুনেও শোনে না কানে।
যত পায় বেত না পায় বেতন,   তবু না চেতন মানে।
বড়ো প্রয়োজন, ডাকি প্রাণপণ   চীৎকার করি “কেষ্টা”—
যত করি তাড়া নাহি পাই সাড়া,   খুঁজে ফিরি সারা দেশটা।
তিনখানা দিলে একখানা রাখে,   বাকি কোথা নাহি জানে;
একখানা দিলে নিমেষ ফেলিতে   তিনখানা করে আনে।
যেখানে সেখানে দিবসে দুপুরে   নিদ্রাটি আছে সাধা;
মহাকলরবে গালি দেই যবে   “পাজি হতভাগা গাধা”—
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সে হাসে,   দেখে জ্বলে যায় পিত্ত।
তবু মায়া তার ত্যাগ করা ভার— বড়ো পুরাতন ভৃত্য।

ঘরের কর্ত্রী রুক্ষমূর্তি   বলে, “আর পারি নাকো,
রহিল তোমার এ ঘর‐দুয়ার,   কেষ্টারে লয়ে থাকো।
না মানে শাসন   বসন বাসন   অশন আসন যত
কোথায় কী গেল, শুধু টাকাগুলো   যেতেছে জলের মতো।
গেলে সে বাজার সারা দিনে আর   দেখা পাওয়া তার ভার—
করিলে চেষ্টা কেষ্টা ছাড়া কি   ভৃত্য মেলে না আর!”
শুনে মহা রেগে ছুটে যাই বেগে,   আনি তার টিকি ধরে;
বলি তারে, “পাজি, বেরো তুই আজই,   দূর করে দিনু তোরে।”
ধীরে চলে যায়, ভাবি গেল দায়;   পরদিনে উঠে দেখি,
হুঁকাটি বাড়ায়ে রয়েছে দাঁড়ায়ে   বেটা বুদ্ধির ঢেঁকি—
প্রসন্ন মুখ, নাহি কোনো দুখ,   অতি অকাতর চিত্ত!
ছাড়ালে না ছাড়ে, কী করিব তারে—  মোর পুরাতন ভৃত্য!

সে বছরে ফাঁকা পেনু কিছু টাকা   করিয়া দালালগিরি।
করিলাম মন শ্রীবৃন্দাবন   বারেক আসিব ফিরি।
পরিবার তায় সাথে যেতে চায়,   বুঝায়ে বলিনু তারে—
পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য,   নহিলে খরচ বাড়ে।
লয়ে রশারশি করি কষাকষি   পোঁটলাপুঁটলি বাঁধি
বলয় বাজায়ে বাক্স সাজায়ে   গৃহিণী কহিল কাঁদি,
“পরদেশে গিয়ে কেষ্টারে নিয়ে   কষ্ট অনেক পাবে।”
আমি কহিলাম, “আরে রাম রাম!   নিবারণ সাথে যাবে।”
রেলগাড়ি ধায়; হেরিলাম হায়   নামিয়া বর্ধমানে—
কৃষ্ণকান্ত অতি প্রশান্ত,   তামাক সাজিয়া আনে!
স্পর্ধা তাহার হেনমতে আর    কত বা সহিব নিত্য!
যত তারে দুষি তবু হনু খুশি   হেরি পুরাতন ভৃত্য!

নামিনু শ্রীধামে— দক্ষিণে বামে   পিছনে সমুখে যত
লাগিল পাণ্ডা, নিমেষে প্রাণটা   করিল কণ্ঠাগত।
জন‐ছয়‐সাতে  মিলি এক‐সাথে   পরমবন্ধুভাবে
করিলাম বাসা; মনে হল আশা,   আরামে দিবস যাবে।
কোথা ব্রজবালা কোথা বনমালা,   কোথা বনমালী হরি!
কোথা হা হন্ত, চিরবসন্ত!   আমি বসন্তে মরি।
বন্ধু যে যত স্বপ্নের মতো   বাসা ছেড়ে দিল ভঙ্গ;
আমি একা ঘরে ব্যাধি‐খরশরে   ভরিল সকল অঙ্গ।
ডাকি নিশিদিন সকরুণ ক্ষীণ,   “কেষ্ট আয় রে কাছে।
এত দিনে শেষে আসিয়া বিদেষে   প্রাণ বুঝি নাহি বাঁচে।”
হেরি তার মুখ ভরে ওঠে বুক,    সে যেন পরম বিত্ত—
নিশিদিন ধরে দাঁড়ায়ে শিয়রে   মোর পুরতন ভৃত্য।

মুখে দেয় জল, শুধায় কুশল,   শিরে দেয় মোর হাত;
দাঁড়ায়ে নিঝুম, চোখে নাই ঘুম,   মুখে নাই তার ভাত।
বলে বার বার, “কর্তা, তোমার   কোনো ভয় নাই, শুন—
যাবে দেশে ফিরে, মাঠাকুরানীরে   দেখিতে পাইবে পুন।”
লভিয়া আরাম আমি উঠিলাম;   তাহারে ধরিল জ্বরে;
নিল সে আমার কালব্যাধিভার   আপনার দেহ‐’পরে।
হয়ে জ্ঞানহীন কাটিল দু দিন,   বন্ধ হইল নাড়ী;
এতবার তারে গেনু ছাড়াবারে,  এতদিনে গেল ছাড়ি।
বহুদিন পরে আপনার ঘরে   ফিরিনু সারিয়া তীর্থ;
আজ সাথে নেই চিরসাথি সেই   মোর পুরাতন ভৃত্য।


===============================================

বাঁশি

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


কিনু গোয়ালার গলি।
                দোতলা বাড়ির
       লোহার-গরাদে-দেওয়া একতলা ঘর
                  পথের ধারেই।
     লোনাধরা দেয়ালেতে মাঝে মাঝে ধসে গেছে বালি,
           মাঝে মাঝে স্যাঁতাপড়া দাগ।
     মার্কিন থানের মার্কা একখানা ছবি
               সিদ্ধিদাতা গণেশের
                         দরজার 'পরে আঁটা।
           আমি ছাড়া ঘরে থাকে আর একটি জীব
                      এক ভাড়াতেই,
                             সেটা টিকটিকি।
                     তফাত আমার সঙ্গে এই শুধু,
                          নেই তার অন্নের অভাব॥


         বেতন পঁচিশ টাকা,
               সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি।
খেতে পাই দত্তদের বাড়ি
        ছেলেকে পড়িয়ে।
শেয়ালদা ইস্টিশনে যাই,
    সন্ধ্যেটা কাটিয়ে আসি,
       আলো জ্বালাবার দায় বাঁচে।
           এঞ্জিনের ধস্ ধস্,
               বাঁশির আওয়াজ,
                   যাত্রীর ব্যস্ততা,
                      কুলি-হাঁকাহাঁকি।
                         সাড়ে-দশ বেজে যায়,
         তার পরে ঘরে এসে নিরালা নিঃঝুম অন্ধকার॥

  ধলেশ্বরী-নদীতীরে পিসিদের গ্রাম---
               তাঁর দেওরের মেয়ে,
  অভাগার সাথে তার বিবাহের ছিল ঠিকঠাক।
         লগ্ন শুভ, নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেল---
              সেই লগ্নে এসেছি পালিয়ে।
                    মেয়েটা তো রক্ষে পেলে,
                          আমি তথৈবচ।
  ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া---
            পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর॥

                          বর্ষা ঘনঘোর।
                    ট্রামের খরচা বাড়ে,
              মাঝে মাঝে মাইনেও কাটা যায়।
                    গলিটার কোণে কোণে
              জমে ওঠে, পচে ওঠে
          আমের খোসা ও আঁঠি, কাঁঠালের ভূতি,
                 মাছের কান্‌কা,
                        মরা বেড়ালের ছানা---
               ছাইপাঁশ আরো কত কী যে।
            ছাতার অবস্থাখানা জরিমানা-দেওয়া
                   মাইনের মতো,
                           বহু ছিদ্র তার।
                        আপিসের সাজ
               গোপীকান্ত গোঁসাইয়ের মনটা যেমন,
                    সর্বদাই রসসিক্ত থাকে।
                        বাদলের কালো ছায়া
                    স্যাঁত্‍‌সেঁতে ঘরটাতে ঢুকে
                        কলে পড়া জন্তুর মতন
                             মূর্ছায় অসাড়!
                    দিনরাত, মনে হয়, কোন্ আধমরা
               জগতের সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছি।

               গলির মোড়েই থাকে কান্তবাবু---
                    যত্নে-পাট-করা লম্বা চুল,
                         বড়ো বড়ো চোখ,
                               শৌখিন মেজাজ।
                         কর্নেট বাজানো তার শখ।
                মাঝে মাঝে সুর জেগে ওঠে
                            এ গলির বীভত্‍‌স বাতাসে---
                কখনো গভীর রাতে,
                         ভোরবেলা আলো-অন্ধকারে,
                কখনো বৈকালে
                         ঝিকিমিকি আলো-ছায়ায়।
                               হঠাত্‍‌ সন্ধ্যায়
        সিন্ধু-বারোয়াঁয় লাগে তান,
           সমস্ত আকাশে বাজে
               অনাদি কালের বিরহবেদনা।
           তখনি মুহূর্তে ধরা পড়ে
               এ গলিটা ঘোর মিছে
        দুর্বিষহ মাতালের প্রলাপের মতো।
           হঠাত্‍‌ খবর পাই মনে,
    আকবর বাদশার সঙ্গে
           হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।
                বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে
                     ছেঁড়া ছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে
                          এক বৈকুণ্ঠের দিকে॥

         এ গান যেখানে সত্য
              অনন্ত গোধুলিলগ্নে
                    সেইখানে
                        বহি চলে ধলেশ্বরী,
              তীরে তমালের ঘন ছায়া---
                    আঙিনাতে
              যে আছে অপেক্ষা ক'রে, তার
       পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর॥

===============================================

প্রার্থনা

    রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


চিত্ত যেথা ভয়শূণ্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি,
যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে
উচ্ছ্বাসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়,
যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি
বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি-
পৌরুষেরে করে নি শতধা, নিত্য যেথা
তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা,
নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ,
ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।।



===============================================

বিসর্জন

  রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


দুইটি কোলের ছেলে গেছে পর পর
বয়স না হতে হতে পুরা দু বছর।
এবার ছেলেটি তার জন্মিল যখন
স্বামীরেও হারালো মল্লিকা। বন্ধুজন
বুঝাইল--- পূর্বজন্মে ছিল বহু পাপ,
এ জনমে তাই হেন দারুণ সন্তাপ।
শোকানলদগ্ধ নারী একান্ত বিনয়ে
অজ্ঞাত জন্মের পাপ শিরে বহি লয়ে
প্রায়শ্চিত্তে দিল মন। মন্দিরে মন্দিরে
যেথা সেথা গ্রামে গ্রামে পূজা দিয়া ফিরে।
ব্রতধ্যান-উপবাসে আহ্নিকে তর্পণে
কাটে দিন ধূপে দীপে নৈবেদ্যে চন্দনে,
পূজাগৃহে; কেশে বাঁধি রাখিল মাদুলি
কুড়াইয়া শত ব্রাহ্মণের পদধূলি;
শুনে রামায়ণকথা; সন্ন্যাসী-সাধুরে
ঘরে আনি আশীর্বাদ করায় শিশুরে।
বিশ্বমাঝে আপনারে রাখি সর্ব-নীচে
সবার প্রসন্ন দৃষ্টি অভাগী মাগিছে
আপন সন্তান-লাগি; সূর্য চন্দ্র হতে
পশুপক্ষী পতঙ্গ অবধি--- কোনোমতে
কেহ পাছে কোনো অপরাধ লয় মনে,
পাছে কেহ করে ক্ষোভ, অজানা কারণে
পাছে কারো লাগে ব্যথা, সকলের কাছে
আকুল বেদনা-ভরে দীন হয়ে আছে।

যখন বছর-দেড় বয়স শিশুর---
যকৃতের ঘটিল বিকার; জ্বরাতুর
দেহখানি শীর্ণ হয়ে আসে। দেবালয়ে
মানিল মানত মাতা, পদামৃত লয়ে
করাইল পান, হরিসংকীর্তন-গানে
কাঁপিল প্রাঙ্গণ। ব্যাধি শান্তি নাহি মানে।
কাঁদিয়া শুধালো নারী, ``ব্রাহ্মণঠাকুর,
এত দুঃখে তবু পাপ নাহি হল দূর!
দিনরাত্রি দেবতার মেনেছি দোহাই,
দিয়েছি এত যে পূজা তবু রক্ষা নাই!
তবু কি নেবেন তাঁরা আমার বাছারে!
এত ক্ষুধা দেবতার! এত ভারে ভারে
নৈবেদ্য দিলাম খেতে বেচিয়া গহনা,
সর্বস্ব খাওয়ানু তবু ক্ষুধা মিটিল না!'
ব্রাহ্মণ কহিল, 'বাছা, এ যে ঘোর কলি।
অনেক করেছ বটে তবু এও বলি---
আজকাল তেমন কি ভক্তি আছে কারো?
সত্যযুগে যা পারিত তা কি আজ পারো?
দানবীর কর্ণ-কাছে ধর্ম যবে এসে
পুত্রেরে চাহিল খেতে ব্রাহ্মণের বেশে,
নিজ হস্তে সন্তানে কাটিল; তখনি সে
শিশুরে ফিরিয়া পেল চক্ষের নিমেষে।
শিবিরাজা শ্যেনরূপী ইন্দ্রের মুখেতে
আপন বুকের মাংস কাটি দিল খেতে---
পাইল অক্ষয় দেহ। নিষ্ঠা এরে বলে।
তেমন কি এ কালেতে আছে ভূমণ্ডলে?
মনে আছে ছেলেবেলা গল্প শুনিয়াছি
মার কাছে--- তাঁদের গ্রামের কাছাকাছি
ছিল এক বন্ধ্যা নারী, না পাইয়া পথ
প্রথম গর্ভের ছেলে করিল মানত
মা-গঙ্গার কাছে। শেষে পুত্রজন্ম-পরে,
অভাগী বিধবা হল; গেল সে সাগরে,
কহিল সে নিষ্ঠাভরে মা-গঙ্গারে ডেকে,
'মা, তোমারি কোলে আমি দিলাম ছেলেকে---
এ মোর প্রথম পুত্র, শেষ পুত্র এই,
এ জন্মের তরে আর পুত্র-আশা নেই।'
যেমনি জলেতে ফেলা, মাতা ভাগীরথী
মকরবাহিনী-রূপে হয়ে মূর্তিমতী
শিশু লয়ে আপনার পদ্মকরতলে
মার কোলে সমর্পিল।--- নিষ্ঠা এরে বলে।'

মল্লিকা ফিরিয়া এল নতশির ক'রে,
আপনারে ধিক্কারিল--- 'এত দিন ধরে
বৃথা ব্রত করিলাম, বৃথা দেবার্চনা---
নিষ্ঠাহীনা পাপিষ্ঠারে ফল মিলিল না।'

ঘরে ফিরে এসে দেখে শিশু অচেতন
জ্বরাবেশে; অঙ্গ যেন অগ্নির মতন।
ঔষধ গিলাতে যায় যত বার বার
পড়ে যায়--- কণ্ঠ দিয়া নামিল না আর।
দন্তে দন্তে গেল আঁটি। বৈদ্য শির নাড়ি
ধীরে ধীরে চলি গেল রোগীগৃহ ছাড়ি।
সন্ধ্যার আঁধারে শূন্য বিধবার ঘরে
একটি মলিন দীপ শয়নশিয়রে,
একা শোকাতুরা নারী। শিশু একবার
জ্যোতিহীন আঁখি মেলি যেন চারি ধার
খুঁজিল কাহারে। নারী কাঁদিল কাতর---
'ও মানিক, ওরে সোনা, এই-যে মা তোর,
এই-যে মায়ের কোল, ভয় কী রে বাপ।'
বক্ষে তারে চাপি ধরি তার জ্বরতাপ
চাহিল কাড়িয়া নিতে অঙ্গে আপনার
প্রাণপণে। সহসা বাতাসে গৃহদ্বার
খুলে গেল; ক্ষীণ দীপ নিবিল তখনি;
সহসা বাহির হতে কলকলধ্বনি
পশিল গৃহের মাঝে। চমকিল নারী,
দাঁড়ায়ে উঠিল বেগে শয্য়াতল ছাড়ি;
কহিল, 'মায়ের ডাক ঐ শোনা যায়---
ও মোর দুখীর ধন, পেয়েছি উপায়---
তোর মার কোল চেয়ে সুশীতল কোল
আছে ওরে বাছা।'

                   জাগিয়াছে কলরোল
অদূরে জাহ্নবীজলে, এসেছে জোয়ার
পূর্ণিমায়। শিশুর তাপিত দেহভার
বক্ষে লয়ে মাতা, গেল শূন্য ঘাট-পানে।
কহিল, 'মা, মার ব্যথা যদি বাজে প্রাণে
তবে এ শিশুর তাপ দে গো মা, জুড়ায়ে।
একমাত্র ধন মোর দিনু তোর পায়ে
একমনে।' এত বলি সমর্পিল জলে
অচেতন শিশুটিরে লয়ে করতলে
চক্ষু মুদি। বহুক্ষণ আঁখি মেলিল না।
ধ্যানে নিরখিল বসি, মকরবাহনা
জ্যোতির্ময়ী মাতৃমূর্তি ক্ষুদ্র শিশুটিরে
কোলে করে এসেছেন, রাখি তার শিরে
একটি পদ্মের দল। হাসিমুখে ছেলে
অনিন্দিত কান্তি ধরি দেবী-কোল ফেলে
মার কোলে আসিবারে বাড়ায়েছে কর।
কহে দেবী, 'রে দুঃখিনী, এই তুই ধর্,
তোর ধন তোরে দিনু।' রোমাঞ্চিতকায়
নয়ন মেলিয়া কহে, 'কই মা... কোথায়!'
পরিপূর্ণ চন্দ্রালোকে বিহ্বলা রজনী;
গঙ্গা বহি চলি যায় করি কলধ্বনি।
চীত্‍‌কারি উঠিল নারী, 'দিবি নে ফিরায়ে!'
মর্মরিল বনভূমি দক্ষিণের বায়ে।


===============================================

বীরপুরুষ

 রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে
     মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে ।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ’পরে
     টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে ।
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে
     রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে ।

     সন্ধে হল,সূর্য নামে পাটে
     এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে ।
ধূ ধূ করে যে দিক পানে চাই
কোনোখানে জনমানব নাই,
তুমি যেন আপনমনে তাই
     ভয় পেয়েছ; ভাবছ, এলেম কোথা?
আমি বলছি, ‘ভয় পেয়ো না মা গো,
     ঐ দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা ।’

চোরকাঁটাতে মাঠ রয়েছে ঢেকে,
    মাঝখানেতে পথ গিয়েছে বেঁকে ।
গোরু বাছুর নেইকো কোনোখানে,
সন্ধে হতেই গেছে গাঁয়ের পানে,
আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে,
     অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো ।
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে,
      ‘দিঘির ধারে ঐ যে কিসের আলো!’

     এমন সময় 'হারে রে রে রে রে’
     ঐ যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে ।
তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে
ঠাকুর দেবতা স্মরণ করছ মনে,
বেয়ারাগুলো পাশের কাঁটাবনে
     পালকি ছেড়ে কাঁপছে থরোথরো।
আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে,
     ‘আমি আছি, ভয় কেন মা কর।’

হাতে লাঠি, মাথায় ঝাঁকড়া চুল
     কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল ।
আমি বলি, ‘দাঁড়া, খবরদার!
এক পা আগে আসিস যদি আর -
এই চেয়ে দেখ আমার তলোয়ার,
     টুকরো করে দেব তোদের সেরে ।’
শুনে তারা লম্ফ দিয়ে উঠে
     চেঁচিয়ে উঠল, ‘হারে রে রে রে রে।’

     তুমি বললে, ‘যাস না খোকা ওরে’
     আমি বলি, ‘দেখো না চুপ করে।’
ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম তাদের মাঝে,
ঢাল তলোয়ার ঝন্‌ঝনিয়ে বাজে
কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে,
     শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা।
কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে,
     কত লোকের মাথা পড়ল কাটা।

এত লোকের সঙ্গে লড়াই করে
     ভাবছ খোকা গেলই বুঝি মরে।
আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে
বলছি এসে, ‘লড়াই গেছে থেমে’,
তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে
     চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে -
বলছ, ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল!
     কী দুর্দশাই হত তা না হলে।’

     রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা -
     এমন কেন সত্যি হয় না আহা।
ঠিক যেন এক গল্প হত তবে,
শুনত যারা অবাক হত সবে,
দাদা বলত, ‘কেমন করে হবে,
     খোকার গায়ে এত কি জোর আছে।’
পাড়ার লোকে বলত সবাই শুনে,
      ‘ভাগ্যে খোকা ছিল মায়ের কাছে।’


===============================================

বোঝাপড়া

 রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।
কেউ বা তোমায় ভালোবাসে
কেউ বা বাসতে পারে না যে,
কেউ বিকিয়ে আছে, কেউ বা
সিকি পয়সা ধারে না যে,
কতকটা যে স্বভাব তাদের
কতকটা বা তোমারো ভাই,
কতকটা এ ভবের গতিক—
সবার তরে নহে সবাই।
তোমায় কতক ফাঁকি দেবে
তুমিও কতক দেবে ফাঁকি,
তোমার ভোগে কতক পড়বে
পরের ভোগে থাকবে বাকি,
মান্ধাতারই আমল থেকে
চলে আসছে এমনি রকম—
তোমারি কি এমন ভাগ্য
বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!
মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।

অনেক ঝঞ্ঝা কাটিয়ে বুঝি
এলে সুখের বন্দরেতে,
জলের তলে পাহাড় ছিল
লাগল বুকের অন্দরেতে,
মুহূর্তেকে পাঁজরগুলো
উঠল কেঁপে আর্তরবে—
তাই নিয়ে কি সবার সঙ্গ
ঝগড়া করে মরতে হবে?
ভেসে থাকতে পার যদি
সেইটে সবার চেয়ে শ্রেয়,
না পার তো বিনা বাক্যে
টুপ করিয়া ডুবে যেয়ো।
এটা কিছু অপূর্ব নয়,
ঘটনা সামান্য খুবই—
শঙ্কা যেথায় করে না কেউ
সেইখানে হয় জাহাজ-ডুবি।
মনেরে তাই কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।

তোমার মাপে হয় নি সবাই
তুমিও হও নি সবার মাপে,
তুমি মর কারো ঠেলায়
কেউ বা মরে তোমার চাপে—
তবু ভেবে দেখতে গেলে
এমনি কিসের টানাটানি?
তেমন করে হাত বাড়ালে
সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি।
আকাশ তবু সুনীল থাকে,
মধুর ঠেকে ভোরের আলো,
মরণ এলে হঠাৎ দেখি
মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো।
যাহার লাগি চক্ষু বুজে
বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর
তাহারে বাদ দিয়েও দেখি
বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর।
মনেরে তাই কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।

নিজের ছায়া মস্ত করে
অস্তাচলে বসে বসে
আঁধার করে তোল যদি
জীবনখানা নিজের দোষে,
বিধির সঙ্গ বিবাদ করে
নিজের পায়েই কুড়ুল মার,
দোহাই তবে এ কার্যটা
যত শীঘ্র পার সারো।
খুব খানিকটে কেঁদে কেটে
অশ্রু ঢেলে ঘড়া ঘড়া
মনের সঙ্গ এক রকমে
করে নে ভাই, বোঝাপড়া।
তাহার পরে আঁধার ঘরে
প্রদীপখানি জ্বালিয়ে তোলো—
ভুলে যা ভাই, কাহার সঙ্গে
কতটুকুন তফাত হল।
মনেরে তাই কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।

===============================================

ব্যর্থ

 রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


যদি     প্রেম দিল না প্রাণে
কেন     ভোরের আকাশ ভরে দিলে     এমন গানে গানে?
                        কেন     তারার মালা গাঁথা,
                        কেন     ফুলের শয়ন পাতা,
কেন     দখিন হাওয়া গোপন কথা     জানায় কানে কানে?।

                        যদি     প্রেম দিলে না প্রাণে
কেন     আকাশ তবে এমন চাওয়া     চায় এ মুখের পানে?
                        তবে     ক্ষণে ক্ষণে কেন
                        আমার     হৃদয় পাগল হেন,
তরী     সেই সাগরে ভাসায় যাহার     কূল সে নাহি জানে?।


===============================================

বর্ষার দিনে

  রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর


এমন দিনে তারে বলা যায়
          এমন ঘনঘোর বরিষায় -
এমন মেঘস্বরে          বাদল-ঝরঝরে
          তপনহীন ঘন তমসায়।।

          সে কথা শুনিবে না কেহ আর,
          নিভৃত নির্জন চারি ধার।
দুজনে মুখোমুখি          গভীর দুখে দুখি,
          আকাশে জল ঝরে অনিবার -
          জগতে কেহ যেন নাহি আর।।

          সমাজ সংসার মিছে সব,
          মিছে এ জীবনের কলরব।
কেবল আঁখি দিয়ে          আঁখির সুধা পিয়ে
          হৃদয় দিয়ে হৃদি-অনুভব -
          আঁধারে মিশে গেছে আর সব।।

          বলিতে ব্যথিবে না নিজ কান,
          চমকি উঠিবে না নিজ প্রাণ।
সে কথা আঁখিনীরে          মিশিয়া যাবে ধীরে,
          বাদলবায়ে তার অবসান -
          সে কথা ছেয়ে দিবে দুটি প্রাণ।।

          তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
          নামাতে পারি যদি মনোভার!
শ্রাবণবরিষনে          একদা গৃহকোণে
          দু কথা বলি যদি কাছে তার
          তাহাতে আসে যাবে কিবা কার।।

          আছে তো তার পরে বারো মাস -
          উঠিবে কত কথা, কত হাস।
আসিবে কত লোক,          কত-না দুখশোক,
          সে কথা কোনখানে পাবে নাশ -
          জগৎ চলে যাবে বারো মাস।।

          ব্যাকুল বেগে আজি বহে বায়,
          বিজুলি থেকে থেকে চমকায়।
যে কথা এ জীবনে          রহিয়া গেল মনে
          সে কথা আজি যেন বলা যায়
          এমন ঘনঘোর বরিষায়।।





অক্ষমতা

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর
যেন রে অভিশপ্ত প্রেতের পিপাসা
সলিল রয়েছে 'ড়ে, শুধু দেহ নাই।
কেবল হৃদয়ের দুর্বল দুরাশা
সাধের বস্তুর মাঝে করে চাই - চাই।
দুটি চরণেতে বেঁধে ফুলের শৃঙ্খল
কেবল পথের পানে চেয়ে বসে থাকা!
মানবজীবন যেন সকলি নিষ্ফল
বিশ্ব যেন চিত্রপট, আমি যেন আঁকা!
চিরদিন বুভুক্ষিত প্রাণহুতাশন
আমারে করিছে ছাই প্রতি পলে পলে,
মহত্ত্বের আশা শুধু ভারের মতন
আমারে ডুবায়ে দেয় জড়ত্বের তলে।
কোথা সংসারের কাজে জাগ্রত হৃদয়!
কোথা রে সাহস মোর অস্থিমজ্জাময়!

==========================================================

অঙ্গের বাঁধনে বাঁধাপড়া আমার প্রাণ

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর
অঙ্গের বাঁধনে বাঁধাপড়া আমার প্রাণ
আকস্মিক চেতনার নিবিড়তায়
চঞ্চল হয়ে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে,
তখন কোন্কথা জানাতে তার এত অধৈর্য।
--
যে কথা দেহের অতীত।
খাঁচার পাখির কণ্ঠে যে বাণী
সে তো কেবল খাঁচারি নয়,
তার মধ্যে গোপনে আছে সুদূর অগোচরের অরণ্য-মর্মর,
আছে করুণ বিস্মৃতি।
সামনে তাকিয়ে চোখের দেখা দেখি--
তো কেবলি দেখার জাল-বোনা নয়।--
বসুন্ধরা তাকিয়ে থাকেন নির্নিমেষে
দেশ-পারানো কোন্দেশের দিকে,
দিগ্বলয়ের ইঙ্গিতলীন
কোন্কল্পলোকের অদৃশ্য সংকেতে।
দীর্ঘপথ ভালোমন্দয় বিকীর্ণ,
রাত্রিদিনের যাত্রা দুঃখসুখের বন্ধুর পথে।
শুধু কেবল পথ চলাতেই কি পথের লক্ষ্য?
ভিড়ের কলরব পেরিয়ে আসছে গানের আহ্বান,
তার সত্য মিলবে কোন্খানে?
মাটির তলায় সুপ্ত আছে বীজ।
তাকে স্পর্শ করে চৈত্রের তাপ,
মাঘের হিম, শ্রাবণের বৃষ্টিধারা।
অন্ধকারে সে দেখছে অভাবিতের স্বপ্ন।
স্বপ্নেই কি তার শেষ?
উষার আলোয় তার ফুলের প্রকাশ;
আজ নেই, তাই বলে কি নেই কোনোদিনই?

==========================================================

অভিমান

-রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর
কারে দিব দোষ বন্ধু, কারে দিব দোষ!
বৃথা কর আস্ফালন, বৃথা কর রোষ।
যারা শুধু মরে কিন্তু নাহি দেয় প্রাণ,
কেহ কভু তাহাদের করে নি সম্মান।
যতই কাগজে কাঁদি, যত দিই গালি,
কালামুখে পড়ে তত কলঙ্কের কালি।
যে তোমারে অপমান করে অহর্নিশ
তারি কাছে তারি 'পরে তোমার নালিশ!
নিজের বিচার যদি নাই নিজহাতে,
পদাঘাত খেয়ে যদি না পার ফিরাতে--
তবে ঘরে নতশিরে চুপ করে থাক্‌,
সাপ্তাহিকে দিগ্বিদিকে বাজাস নে ঢাক।
একদিকে অসি আর অবজ্ঞা অটল,
অন্য দিকে মসী আর শুধু অশ্রুজল।

==========================================================

আকাশের চাঁদ

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর
হাতে তুলে দাও আকাশের চাঁদ
                
এই হল তার বুলি।
        
দিবস রজনী যেতেছে বহিয়া,
                
কাঁদে সে দু হাত তুলি।
        
হাসিছে আকাশ, বহিছে বাতাস,
                
পাখিরা গাহিছে সুখে।
        
সকালে রাখাল চলিয়াছে মাঠে,
                
বিকালে ঘরের মুখে।
        
বালক বালিকা ভাই বোনে মিলে
                
খেলিছে আঙিনা-কোণে,
        
কোলের শিশুরে হেরিয়া জননী
                
হাসিছে আপন মনে।
          
কেহ হাটে যায় কেহ বাটে যায়
                
চলেছে যে যার কাজে
        
কত জনরব কত কলরব
                
উঠিছে আকাশমাঝে।
        
পথিকেরা এসে তাহারে শুধায় ,
               '
কে তুমি কাঁদিছ বসি '
        
সে কেবল বলে নয়নের জলে,
               '
হাতে পাই নাই শশী।'
  
        
সকালে বিকালে ঝরি পড়ে কোলে
                
অযাচিত ফুলদল,
          
দখিন সমীর বুলায় ললাটে
                
দক্ষিণ করতল।
        
প্রভাতের আলো আশিস-পরশ
                
করিছে তাহার দেহে,
        
রজনী তাহারে বুকের আঁচলে
                
ঢাকিছে নীরব স্নেহে।
        
কাছে আসি শিশু মাগিছে আদর
                
কণ্ঠ জড়ায়ে ধরি,
        
পাশে আসি যুবা চাহিছে তাহারে
                
লইতে বন্ধু করি।
        
এই পথে গৃহে কত আনাগোনা,
                
কত ভালোবাসাবাসি,
        
সংসারসুখ কাছে কাছে তার
                
কত আসে যায় ভাসি,
        
মুখ ফিরাইয়া সে রহে বসিয়া,
                
কহে সে নয়নজলে,
        '
তোমাদের আমি চাহি না কারেও,
                
শশী চাই করতলে।'
  
        
শশী যেথা ছিল সেথাই রহিল,
                
সেও 'সে এক ঠাঁই।
        
অবশেষে যবে জীবনের দিন
                
আর বেশি বাকি নাই,
        
এমন সময়ে সহসা কী ভাবি
                
চাহিল সে মুখ ফিরে
        
দেখিল ধরণী শ্যামল মধুর
                
সুনীল সিন্ধুতীরে।
        
সোনার ক্ষেত্রে কৃষাণ বসিয়া
                
কাটিতেছে পাকা ধান,
        
ছোটো ছোটো তরী পাল তুলে যায়,
                
মাঝি বসে গায় গান।
        
দূরে মন্দিরে বাজিছে কাঁসর,
                
বধূরা চলেছে ঘাটে,
        
মেঠো পথ দিয়ে গৃহস্থ জন
                
আসিছে গ্রামের হাটে।
        
নিশ্বাস ফেলি রহে আঁখি মেলি,
                
কহে ম্রিয়মাণ মন,
        '
শশী নাহি চাই যদি ফিরে পাই
                
আর বার জীবন।'
  
        
দেখিল চাহিয়া জীবনপূর্ণ
                
সুন্দর লোকালয়
        
প্রতি দিবসের হরষে বিষাদে
                
চির-কল্লোলময়।
        
স্নেহসুধা লয়ে গৃহের লক্ষ্মী
                
ফিরিছে গৃহের মাঝে,
        
প্রতি দিবসেরে করিছে মধুর
                
প্রতি দিবসের কাজে।
        
সকাল বিকাল দুটি ভাই আসে
                
ঘরের ছেলের মতো,
        
রজনী সবারে কোলেতে লইছে
                
নয়ন করিয়া নত।
        
ছোটো ছোটো ফুল, ছোটো ছোটো হাসি,
                
ছোটো কথা, ছোটো সুখ,
        
প্রতি নিমেষের ভালোবাসাগুলি,
                
ছোটো ছোটো হাসিমুখ
        
আপনা-আপনি উঠিছে ফুটিয়া
                
মানবজীবন ঘিরি,
        
বিজন শিখরে বসিয়া সে তাই
                
দেখিতেছে ফিরি ফিরি।
  
        
দেখে বহুদূরে ছায়াপুরী-সম
                
অতীত জীবন-রেখা,
        
অস্তরবির সোনার কিরণে
                
নূতন বরনে লেখা।
        
যাহাদের পানে নয়ন তুলিয়া
                
চাহে নি কখনো ফিরে,
        
নবীন আভায় দেখা দেয় তারা
                
স্মৃতিসাগরের তীরে।
        
হতাশ হৃদয়ে কাঁদিয়া কাঁদিয়া
                
পুরবীরাগিণী বাজে,
        
দু-বাহু বাড়ায়ে ফিরে যেতে চায়
                
ওই জীবনের মাঝে।
        
দিনের আলোক মিলায়ে আসিল
                
তবু পিছে চেয়ে রহে
        
যাহা পেয়েছিল তাই পেতে চায়
                
তার বেশি কিছু নহে।
          
সোনার জীবন রহিল পড়িয়া
                
কোথা সে চলিল ভেসে।
        
শশীর লাগিয়া কাঁদিতে গেল কি
                
রবিশশীহীন দেশে

 

No comments:

Post a Comment

হট জোকস ১৮+