Saturday, April 9, 2016

=> নির্মলেন্দু গুণ (৪)

 

আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি

নির্মলেন্দু গুণ


সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
শহিদ মিনার থেকে খসে-পড়া একটি রক্তাক্ত ইট গতকাল আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
সমবেত সকলের মতো আমিও পলাশ ফুল খুব ভালোবাসি, ‘সমকাল’
পার হয়ে যেতে সদ্যফোটা একটি পলাশ গতকাল কানে কানে
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
শাহবাগ এ্যভিন্যুর ঘূর্ণায়িত জলের ঝরনাটি আর্তস্বরে আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
সমবেত সকলের মতো আমারো স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে,
ভালোবাসা আছে_ শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
এই বসন্তের বটমূলে সমবেত ব্যথিত মানুষগুলো সাক্ষী থাকুক,
না-ফোটা কৃষ্ণচূড়ার শুষ্কভগ্ন অপ্রস্তুত প্রাণের ঐ গোপন মঞ্জরীগুলো কান পেতে শুনুক,
আসন্ন সন্ধ্যার এই কালো কোকিলটি জেনে যাক_
আমার পায়ের তলায় পুণ্য মাটি ছুঁয়ে
আমি আজ সেই গোলাপের কথা রাখলাম, আজ সেই পলাশের কথা
রাখলাম, আজ সেই স্বপ্নের কথা রাখলাম।
আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি,
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।


আশাগুলি

নির্মলেন্দু গুণ


জ্যা-মুক্ত হয়নি চিত্ত
অধীর মিলনে কোনোদিন ।
পরশে খুলেছে দ্বার, বারবার
কেটেছে অস্থির ঘুমে
শূন্য চিরশয্যা তুমি-হীন ।
অপক্ব মৈথুনে বিবসনা
শ্লীলতা ভাঙেনি শব্দ,
আমাদের অবিমৃষ্য যুগলযৌবন
অথচ জেগেছে কামে
সুপ্তোত্থিতে, প্রিয়তমে
মুখর মৃণালে, প্রিয় নামে ।
তোমাকে বেসেছি ভালো
তীব্রতম বেদনার লাগি ।
মৃত্যুর শিয়রে বসি
সেই প্রিয় মুখে রাত্রি জাগি
একদিন উচ্চরিত প্রার্থনার ভাষা;
করেছিনু আশা, আজ পূর্ণ হবে ।

দুঃখ করো না, বাঁচো

নির্মলেন্দু গুণ


দুঃখকে স্বীকার করো না, –সর্বনাশ হয়ে যাবে ।
দুঃখ করো না, বাঁচো, প্রাণ ভ’রে বাঁচো ।
বাঁচার আনন্দে বাঁচো । বাঁচো, বাঁচো এবং বাঁচো ।
জানি মাঝে-মাঝেই তোমার দিকে হাত বাড়ায় দুঃখ,
তার কালো লোমশ হাত প্রায়ই তোমার বুক ভেদ করে
চলে যেতে চায়, তা যাক, তোমার বক্ষ যদি দুঃখের
নখরাঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়; যদি গলগল করে রক্ত ঝরে,
তবু দুঃখের হাতকে তুমি প্রশ্রয় দিও না মুহূর্তের তরে ।
তার সাথে করমর্দন করো না, তাকে প্রত্যাখান করো ।
অনুশোচনা হচ্ছে পাপ, দুঃখের এক নিপুণ ছদ্মবেশ ।
তোমাকে বাঁচাতে পারে আনন্দ । তুমি তার হাত ধরো,
তার হাত ধরে নাচো, গাও, বাঁচো, ফুর্তি করো ।
দুঃখকে স্বীকার করো না, মরে যাবে, ঠিক মরে যাবে ।
যদি মরতেই হয় আনন্দের হাত ধ’রে মরো ।
বলো, দুঃখ নয়, আনন্দের মধ্যেই আমার জন্ম,
আনন্দের মধ্যেই আমার মৃত্যু, আমার অবসান । 


বসন্ত বন্দনা

নির্মলেন্দু গুণ


হয়তো ফুটেনি ফুল রবীন্দ্রসঙ্গীতে যত আছে,
হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে
বনের কুসুমগুলি ঘিরে। আকাশে মেলিয়া আঁখি
তবুও ফুটেছে জবা,—দূরন্ত শিমুল গাছে গাছে,
তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্ত পথিক।
এলিয়ে পড়েছে হাওয়া, ত্বকে কী চঞ্চল শিহরন,
মন যেন দুপুরের ঘূর্ণি-পাওয়া পাতা, ভালোবেসে
অনন্ত সঙ্গীত স্রোতে পাক খেয়ে, মৃত্তিকার বুকে
নিমজ্জিত হতে চায়। হায় কি আনন্দ জাগানিয়া।
এমন আগ্রাসী ঋতু থেকে যতই ফেরাই চোখ,
যতই এড়াতে চাই তাকে, দেখি সে অনতিক্রম্য।
বসন্ত কবির মতো রচে তার রম্য কাব্যখানি
নবীন পল্লবে, ফুলে ফুলে। বুঝি আমাকেও শেষে
গিলেছে এ খল-নারী আপাদমস্তক ভালোবেসে।
আমি তাই লঘুচালে বন্দিলাম স্বরূপ তাহার,
সহজ অক্ষরবৃত্তে বাঙলার বসন্ত বাহার।

No comments:

Post a Comment

হট জোকস ১৮+